আনিসুর বুলবুল
দেশের সরকারি সেবাগুলো নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এসব সেবা নিতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষকেই ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। দুর্নীতি, বৈষম্য, হয়রানি কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা-এই চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সাম্প্রতিক ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে ২০২৫’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে।
প্রায় ৮৫ হাজার মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, সরকারি সেবা গ্রহণে তিনজনের একজনকেই দুর্নীতির মুখোমুখি হতে হয়। ঘুষ দিতে হয়েছে ৩১.৬৭ শতাংশ সেবাপ্রার্থীকে।
সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে এসেছে বিআরটিএ, যেখানে ৬৩ শতাংশের বেশি মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর পরই রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, পাসপোর্ট অফিস এবং ভূমি অফিস। নারী-পুরুষের মধ্যে তুলনামূলকভাবে পুরুষরাই বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন, যদিও নারীরাও সুরক্ষিত নন।
নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাবোধের একটি স্পষ্ট চিত্রও ফুটে উঠেছে জরিপে।
দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষই সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলতে নিরাপদ বোধ করেন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোর মানুষ শহরের তুলনায় নিরাপত্তা নিয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী। তবে লিঙ্গভেদে পার্থক্য স্পষ্ট-পুরুষরা নিজেদের অধিক নিরাপদ মনে করলেও নারীদের ক্ষেত্রে এখনো সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
একইভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা গেছে। মাত্র ২৭ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তাঁরা সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে স্বাধীনভাবে মত দিতে পারেন।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বা প্রভাব ফেলার বিশ্বাস রাখেন প্রতি পাঁচজনে মাত্র একজন। এতে বোঝা যায়, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে মানুষের আস্থা এবং সুযোগ-উভয়েরই ঘাটতি রয়েছে।
তবে সবকিছু যে নেতিবাচক, তা নয়। যেমন, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সহজপ্রাপ্যতা এবং ব্যয়ের দিক দিয়ে বেশিরভাগ নাগরিক সন্তুষ্ট। যদিও মান এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণ নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে।
শিক্ষা খাতেও তুলনামূলকভাবে আশাব্যঞ্জক চিত্র দেখা গেছে-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের হার অনেক বেশি এবং খরচও বেশিরভাগ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিয়ে কিছু অসন্তুষ্টি থাকলেও সামগ্রিক চিত্র ইতিবাচকই বলা যায়।
আইনি সহায়তার ক্ষেত্রেও কিছুটা আশাবাদের জায়গা রয়েছে। গত দুই বছরে যাঁরা বিরোধ বা জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদের বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে বিচারপ্রক্রায় প্রবেশ করতে পেরেছেন। যদিও বেশিরভাগই তা করেছেন অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম দিয়ে।
এতসব বিষয়ের মাঝে যে দিকটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, তা হলো বৈষম্য ও হয়রানির অভিজ্ঞতা। প্রতিটি পাঁচজনের একজন নাগরিক বৈষম্য কিংবা হয়রানির শিকার হয়েছেন। শহরে এই হার কিছুটা বেশি। আর্থ-সামাজিক শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যই এখানে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। পরিবার, গণপরিবহন ও কর্মস্থল-এই তিন স্থানেই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের অভিজ্ঞতা হয়েছে।
এই জরিপের ফলাফল আমাদের সামনে একটি দ্বিমুখী বাস্তবতা তুলে ধরে-একদিকে সরকারি সেবা ব্যবস্থায় অনেক অর্জন, সহজপ্রাপ্যতা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা; অন্যদিকে দুর্নীতি, মত প্রকাশে বাধা এবং সামাজিক বৈষম্যের মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জ। একটি সুশাসনভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বার্থে এখন প্রয়োজন নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং জনগণের প্রতি জবাবদিহিতার একটি টেকসই কাঠামো গড়ে তোলা। তাহলেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে আরও মানবিক, আরও সমান সুযোগ সম্পন্ন।