নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারি সফরের নামে একের পর এক বিদেশ ভ্রমণ অব্যাহত রয়েছে, যার আর্থিক ব্যয় যেমন আকাশছোঁয়া, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ তার প্রাপ্তি। সর্বশেষ যুক্তরাজ্য সফরে এ চিত্র আরও স্পষ্ট হয়েছে। এছাড়া তার কাজগুলোকে বড় করে দেখানো ব্যক্তিরাও এখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বিশেষ করে তার উপদেষ্টারা, যারা এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশ সফর নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা করতেন—তারাও এখন নিশ্চুপ।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সর্বশেষ লন্ডন সফর ঘিরে এই নীরবতা ও অস্পষ্টতা যেন আরও দৃষ্টিকটূ হয়ে উঠেছে। সফরটি যেমন ব্যয়ে ছিল বিপুল, তেমনি ফলাফলে ছিল প্রায় শূন্য।
গত ৯ জুন ড. ইউনূস ও তার ৩৮ সদস্যবিশিষ্ট সফরসঙ্গীরা যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পৌঁছান। সেখানে তারা শহরের অন্যতম ব্যয়বহুল হোটেল 'দ্য ডরচেস্টার'-এ চার রাত অবস্থান করেন। এ সময় ৩৭টি কক্ষের জন্য বিল আসে ২১০,৩২৫ ব্রিটিশ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা)। প্রধান উপদেষ্টার নিজস্ব কক্ষ ছিল সবচেয়ে ব্যয়বহুল—প্রতি রাতের ভাড়া ৬,০৪৫ পাউন্ড বা প্রায় ১০ লাখ টাকা। এই একটি কক্ষের মোট খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো সরকারি সফরের যৌক্তিকতা নিরূপণ করা হয় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, চুক্তি বা কূটনৈতিক অগ্রগতির ভিত্তিতে। অথচ এই সফরে এমন কোনো আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম হয়নি বলেই জানা গেছে। সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত পুরস্কার গ্রহণ। সফরের শেষ দিনে বিএনপির নির্বাসিত নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ—ছিল রাজনৈতিক, সম্পূর্ণরূপে সরকারি সফরের পরিধির বাইরে।
সবচেয়ে বিতর্কিত হয়েছে ভ্রমণের মাধ্যম। লন্ডনে রাষ্ট্রীয় বিমান ‘বাংলাদেশ বিমান’ সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করলেও, সফরসঙ্গীরা ভ্রমণ করেছেন এমিরেটস এয়ারলাইনসের ফার্স্ট ও বিজনেস ক্লাসে। ব্যয়, মর্যাদা ও দায়িত্ববোধের প্রশ্নে এ সিদ্ধান্তকে অসংখ্যজনই অনভিপ্রেত বলছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ১০ মাসে ড. ইউনূস করেছেন ১১টি বিদেশ সফর, যার বেশিরভাগই ছিল আমন্ত্রণহীন ও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ফলবিহীন। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থানে এসব সফরের প্রভাব কতটুকু—তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা।
নাগরিক সমাজ, অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন—যেখানে দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অর্থ সংকট প্রকট, সেখানে এই ধরনের ব্যয়বহুল অথচ ফলহীন সফরের যৌক্তিকতা নেই।
এদিকে সরকারে আসার পরপরই ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংস্থা একের পর এক সরকারি অনুমোদন ও বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরে গ্রামীণ ইউনিভার্সিটির অনুমোদন, গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেসের জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স, গ্রামীণ টেলিকমের ডিজিটাল ওয়ালেট চালুর অনুমতি। সেই সাথে আছে, গ্রামীণ ব্যাংকের কর মওকুফ ও সরকারিভাবে ব্যাংকে শেয়ারের পরিমাণ ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা। ইউনূসের বিরুদ্ধে থাকা শ্রম আইন লঙ্ঘন ও অর্থপাচারের মামলা দ্রুত খারিজ হয়ে যাওয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এভাবে নিজ প্রতিষ্ঠানের সুবিধা পাওয়া এবং মামলা খারিজ হওয়া স্বার্থের সংঘর্ষ তৈরি করে এবং জন আস্থা হারানোর ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে, ইউনূসপন্থীরা বলছেন—এই অনুমোদনগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আটকে ছিল, এখন সেগুলো নিয়ম মেনেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূস অবৈধভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে। এরপর থেকে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সমর্থকগোষ্ঠী সবাই তার কর্মকাণ্ডকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো শুরু করে। গত ১১ আগস্ট ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন পরই বিশৃঙ্খল ঢাকার সড়কে ড. ইউনূসের গাড়ি যানজটে আটকে থাকার একটি ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। কারণ তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভঙ্গুর। এমন অবস্থাতেই প্রটোকল ভেঙে সাধারণ মানুষের মতো অপেক্ষা করতে দেখা যায় তাকে। এ ঘটনাটিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানো শুরু করে ইউনূসপন্থীরা। বিশ্লেষকদের মতে— ইউনূস এই ধরনের কর্মকাণ্ড করে আসল প্রশ্নগুলো থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করে থাকেন।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, এক সময়ের ‘পরিবর্তনের আশাবাদ’ এখন যেন বাস্তবতার আঘাতে ক্লান্ত। সরকারি শক্তিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার অভিযোগ নতুন নয়, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—চাইলাম কি, পাইলাম কি?—এই তো লাল স্বাধীনতা?