নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রস্তাবিত তথাকথিত ‘মানবিক করিডোর’ বাস্তবায়নের নামে দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ল্যান্ডয়ের সঙ্গে বৈঠকে এই করিডোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিল।
মার্কিন ষড়যন্ত্র ও গোপন অর্থায়ন: ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে “শক্তিশালী” করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ২৯ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে একটি অপরিচিত প্রতিষ্ঠানে, যেখানে মাত্র দুইজন কর্মী কর্মরত। যদিও তিনি এর পেছনের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেননি, ধারণা করা হচ্ছে—এটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করার একটি কৌশল।
পরে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অর্থায়নের পরিবর্তে যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)-এর মাধ্যমে “বাংলাদেশ–সংঘাত, জবাবদিহিতা ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতি (বি-সিএপিপি)” প্রকল্পের আওতায় সহযোগিতা শুরু করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনূস সরকারের অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাকে কারিগরি সহায়তা ও শাসন কাঠামো সাজানোর জন্য ১ লাখ ৭৭ হাজার ২৩৩ পাউন্ড (প্রায় ২ কোটি টাকা) বরাদ্দ দেওয়া হয় কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যালিনিয়া ইন্টারন্যাশনাল -কে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, আলিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে উইলিয়াম মরিসন নামের এক বিতর্কিত ব্যক্তি, যিনি ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের বড় এক সাহায্য কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মরিসন সেই সময় অ্যাডাম স্মিথ ইন্টারন্যাশনাল (এএসআই)-এর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন এবং সরকারিভাবে গোপন নথি ব্যবহার করে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হন।
করিডোর নিয়ে তারেক রহমানের সম্মতি: রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তাবিত মানবিক করিডোর পরিকল্পনা নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। যদিও বিএনপি প্রকাশ্যে এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে, দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের গোপন বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে
বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী, ১১ জুন লন্ডনে তারেক রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অংশ নেন তারেক রহমান, খলিলুর রহমান ও ড. ইউনূস। বৈঠকটি প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয় এবং মূল আলোচনা হয় খলিল ও তারেকের মধ্যে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, করিডোর ইস্যুতে দলের কৌশল নির্ধারণই ছিল এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।
পরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে ১৪ জুন বাংলাদেশ সময় বেলা ২টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ড. খলিলুর রহমান, যিনি আগে বিএনপি নেতাদের মুখেই করিডোর ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। বিষয়টি দলের অবস্থানকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অস্ত্র পাচার ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ: অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের একটি অংশের সহযোগিতায় টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের মংডু অঞ্চলে অস্ত্র পাচার করা হচ্ছে, যার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মি জড়িত। এমনকি এই চক্রান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও জড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনা দূতাবাস বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানালে খলিল ফের তারেক রহমানের সহায়তা চান বলে জানা গেছে।
করিডোর বাস্তবায়নে বিকল্প পথে ইউনূস গোষ্ঠী: নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে করিডোর বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে বিকল্প পথে এগোচ্ছে ইউনূস গোষ্ঠী। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে "জরুরি খাদ্য ও মানবিক সহায়তা" পাঠানোর দাবিতে একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
১৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান এই নোটিশ পাঠান। নোটিশে বিবাদী করা হয়েছে পররাষ্ট্র সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে। নোটিশে বলা হয়েছে, ১০ দিনের মধ্যে পদক্ষেপ না নিলে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডোর’ এখন আর কেবল একটি ত্রাণ কার্যক্রম নয়—এটি হয়ে উঠেছে একটি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক টুল। এতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আড়ালে যেভাবে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রভাব, বিতর্কিত অর্থায়ন এবং গোপন বৈঠকের সমন্বয়ে করিডোর বাস্তবায়নের কৌশল এগোচ্ছে, তা নীতিগত ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দিক থেকে স্পষ্টভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সর্বজনীন রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। অন্যথায়, মানবিক করিডোরের আড়ালে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও জাতীয় নিরাপত্তা আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে।