নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
সারা দেশে কারাগার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। গত ১০ মাসে অন্তত ২৬ জন নেতাকর্মী কারাগারে, পুলিশি হেফাজতে কিংবা অভিযানকালে প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই নাশকতা বা সহিংসতার অভিযোগে মামলা ছিল, যেগুলো নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে সেগুলো ভুয়া ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত।
সর্বশেষ ১৫ জুন সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজন কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় পুলিশ। এর আগে ঈদের দিন (৭ জুন) ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারে মারা যান ঢাকা দক্ষিণ মহানগরের ৫৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বউবাজার ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক মো. আলী আজগর। অভিযোগ রয়েছে, রিমান্ডে নির্যাতনের ফলে গুরুতর অসুস্থ হলেও যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে তিনি মারা যান।
৩১ মে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মো. ইমাম হোসেন বাচ্চু। ২১ মে হবিগঞ্জের লাখাইয়ে পুলিশের গাড়ি দেখে পালাতে গিয়ে প্রাণ হারান যুবলীগ নেতা ফজল উদ্দিন ইমন। ১ মে রাজশাহীতে একইভাবে মারা যান রাসিকের সাবেক কাউন্সিলর কামাল হোসেন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী ফরজাদ হোসেন সজিব। পরিবারের অভিযোগ, মারামারিতে আহত হয়ে মারা যান তিনি। ১১ মার্চ বগুড়া জেলা কারাগারে মারা যান আওয়ামী লীগ নেতা এমদাদুল হক ভট্টু। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হেফাজতে নিহত হন টাঙ্গাইলের ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম শিপু।
১৭ ফেব্রুয়ারি নওগাঁ জেলা কারাগারে মারা যান মান্দা উপজেলার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিক হোসেন মোল্লা। ১৩ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, যিনি সাভার পৌর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক ছিলেন।
৯ ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলা কারাগারে মারা যান তেরখাদা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আক্তার শিকদার। ১৪ জানুয়ারি নীলফামারী জেলা কারাগারে মারা যান যুবলীগের সাবেক নেতা মমিনুর ইসলাম। ১০ জানুয়ারি গাজীপুর জেলা কারাগারে মারা যান শ্রমিক লীগ নেতা শেখ জহিরুল ইসলাম।
গত ৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিত্য সরকার (৪৪) নামে মানিকগঞ্জ কারাগারের এক হাজতি আসামি মারা গেছেন। তিনি হরিরামপুর উপজেলার ২নং গালা ইউনিয়নের কালৈই ওয়ার্ড শাখা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ছিলেন। নিত্য সরকার হরিরামপুর উপজেলার কালৈই গ্রামের জগদীশ সরকারের ছেলে। তিন সন্তানের বাবা ছিলেন তিনি। পেশায় কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন।
৫ ডিসেম্বর খুলনায় পুলিশের ভয়ে পালাতে গিয়ে মারা যান হেমেশ চন্দ্র মন্ডল,। তিনিপাইকগাছা পৌর আওয়ামী লীগের সদস্য সচিব ছিলেন। ১০ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে মারা যান আতাউর রহমান আঙ্গুর। তিনি পৌর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক ছিলেন। ৯ ডিসেম্বর বগুড়ার গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল মতিন মিঠু কারা হেফাজতে মারা যান।
৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে সেনা হেফাজতে মারা যান যুবলীগ কর্মী হযরত আলী। ২৬ নভেম্বর বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদত আলম ঝুনু কারা হেফাজতে মারা যান। ২৫ নভেম্বর বগুড়ায় পুলিশ হেফাজতে মারা যান দলিল লেখক ও শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুল লতিফ।
১১ নভেম্বর বগুড়া কারাগারে মারা যান পৌর আওয়ামী লীগের নেতা শহিদুল ইসলাম রতন। ১৩ অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান আলীমুজ্জামান চৌধুরী, যিনি মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কল্যাণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১০ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার সাঘাটায় র্যাবের অভিযানে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম ও কর্মী সোহরাব হোসেন আপেল। শফিকুল গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা ইউনিয়নের গোবিন্দী গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। অপরদিকে আপেল গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা ইউনিয়নের গোবিন্দী গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন।
৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জে মারা যান এলাহী সিকদার, যিনি একটি ভুয়া মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। এ পর্যন্ত এসব মৃত্যুর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। নিহতদের স্বজনরা বলছেন, রাজনীতি করার অপরাধে তাদের স্বজনদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে এবং হেফাজতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের এমন মৃত্যুকে আওয়ামী লীগ নেতারা দমন-পীড়নের ফল হিসেবে দেখছেন এবং এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মৃত্যুগুলোর প্যাটার্ন স্পষ্টভাবে একটি রাষ্ট্রীয় দমননীতি নির্দেশ করে। বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ নতুন নয়, তবে এখন শাসকদলের অভ্যন্তরেও যেভাবে ‘অনুপযোগী’ বা ‘নাগরিকভাবে অস্বস্তিকর’ হয়ে উঠেছে এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করা হচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। এই প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও অস্থির করে তুলবে। বিশেষত যখন দলীয় শুদ্ধি অভিযানের আড়ালে ব্যক্তি স্বাধীনতা, বিচারপ্রাপ্তির অধিকার ও মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন ঘটছে। যদি এসব মৃত্যুর যথাযথ ও নিরপেক্ষ তদন্ত না হয়, তবে এটি শুধু রাজনৈতিক অসন্তোষই বাড়াবে না, বরং রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।