নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে মবের মাধ্যমে দেশ ধ্বংসের নীলনকশা রচিত হচ্ছে। ক্ষমতার শূন্যতাকে সুযোগ করে নিয়ে এসব মব সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে দেশের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই নয়, বরং জাতির উন্নয়ন এবং শান্তি বিনষ্ট করে দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা। এই নীলনকশার ফলে সাধারণ মানুষ ও দেশের স্থিতিশীলতা গভীর হুমকির মুখে পড়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সারা দেশে অসংখ্য মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া হয়েছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মবসন্ত্রাসীরা বিনা বাধায়ই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবীদের৷। লুটপাট, দখলের ঘটনা ঘটেছে অনেক। মব সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহতও হয়েছেন অনেকে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম নূরুল হুদা। তার বাসা ঢাকার উত্তরায়। গত রোববার বিকেলে তার বাসার সামনে একটি মব জড়ো হয়। এরপর একদল বিএনপি নেতাকর্মীরা তার বাসায় ঢুকে তাকে বাইরে এনে প্রকাশ্যে গলায় জুতার মালা পরায় ও জুতাপেটা করে। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, নূরুল হুদা সাদা টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরে আছেন এবং তাকে ঘিরে বিএনপি নেতাকর্মীরা জুতার মালা পরিয়ে রেখেছে। একজন ব্যক্তি তাকে জুতা দিয়ে আঘাত করছেন। পুলিশ খুব কাছেই দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কেউ কেউ তাকে ডিম ছুড়ে মারছিল এবং নানা কায়দায় হেনস্তা করছিল। দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে চলে এ মব সন্ত্রাস।
পরে বিএনপির করা একটি মামলায় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখায়। রাতে তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সোমবার আদালতে হাজির করে পুলিশ তাকে চার দিনের রিমান্ডে নেয়।
এর আগে সকালেই (২২ জুন), বিএনপির পক্ষ থেকে ঢাকার শেরে বাংলা নগর থানায় সাবেক তিন নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায়ই একই দিনে গ্রেপ্তার দেখানো হয় নূরুল হুদাকে।
মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ২০১৪ সালের সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, ২০১৮ সালের সিইসি কে এম নূরুল হুদা, ২০২৪ সালের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। পাশাপাশি সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, একে এম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও রয়েছেন।
সাবেক সিইসি-কে মব হেনস্তার ঘটনার পর রোববার রাতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকার আবারও অনুরোধ জানাচ্ছে, কেউ যেন আইন নিজের হাতে না তোলে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতেই হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর আক্রমণ বেআইনি, আইনের শাসনের পরিপন্থী ও একটি ফৌজদারি অপরাধ। যারা মব তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “সাবেক নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার ওপর যে মব জাস্টিস হয়েছে, তা কাম্য নয়। ঘটনাস্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থাকলেও কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এর আগে ২২ মে সেনা সদর দপ্তরে এক সভায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে এক ব্রিফিংয়ে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মব ভায়োলেন্স অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, তবে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিতে থাকবে। তবুও দেশজুড়ে মব ভায়োলেন্স থামেনি।
মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএসএস এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত মব সন্ত্রাসের ২০২টি ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত ও ২০২ জন আহত হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৮৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন মব হিংসায়।
মব ভায়োলেন্সের পরিসর এখন পারিবারিক ক্ষেত্রেও পৌঁছেছে। রোববার হিরো আলম রামপুরায় তার তৃতীয় স্ত্রীর বিরুদ্ধে হট্টগোল শুরু করেন। এরপর স্থানীয়রা "রিয়ামনি" ও এক ব্যক্তি ম্যাক্স অভি রিয়াজকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পরে তারা জামিন পান। একই দিনে লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পরেশ চন্দ্র শীল (৬৯) ও তার ছেলে বিষ্ণুকে মব প্রহার করে সেলুনে আটকে রাখে। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
অভিনেতা সিদ্দিক, হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফা, শিক্ষক মিল্লাত হোসেন—এরা সবাই মব সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। এমনকি পুলিশের নিজস্ব সদস্যরাও নিরাপদ নন। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার ৭০টি ছিল বড় ধরনের।
আদালত চত্বরে পর্যন্ত চলছে এ ধরণের হেনস্তা। সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আইনজীবীরাও আক্রান্ত হয়েছেন আদালত প্রাঙ্গণে। গত ২৩ মে মানিকগঞ্জ আদালতে সাবেক সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের ওপর ডিম নিক্ষেপ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। গত ২৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আদালতের এজলাস থেকে বের হওয়ার সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মব উস্কে মারধরের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালতে তোলার সময় 'সংক্ষুব্ধ বিএনপন্থী আইনজীবীরা' স্লোগান দেন এবং শুনানি শেষে এজলাস থেকে বের হওয়ার সময় তাকে চড়-থাপ্পড় দেন।
সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “নূরুল হুদা তো সাংবিধানিক পদে ছিলেন। তাকে মব দিয়ে বিচার করা যায় না। তিনি যদি অপরাধী হন, তবে আদালতেই বিচার হোক। কিন্তু পুলিশ তখন ব্যবস্থা নেয়নি—এটি বড় প্রশ্ন।”
মঙ্গলবার (২৪ জুন) সকাল রাজধানীর হাতিরপুলে এক সংবাদ সম্মেলনে গণসংহতি আন্দোলনের মুখপাত্র জোনায়েদ সাকি বলেন, মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয়, শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানো যাবে না বলে জানিয়েছেন মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয়, শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানো যাবে না।
মব ভায়োলেন্সে প্যারালাইজড দেশের গণমাধ্যম: বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এক গভীর সংকটে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের চাপ, মব ভায়োলেন্স এবং সাংবাদিকদের ওপর অনবরত হুমকির কারণে দেশের সংবাদমাধ্যম কার্যত প্যারালাইজড হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল থেকে সাংবাদিক ছাঁটাই, এক্রিডিটেশন বাতিল, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে মিডিয়া ব্যবহার—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতার ওপর এক ঘনীভূত কালো মেঘ জমেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সময় টিভি থেকে চাকরিচ্যুত হন প্রধান বার্তা সম্পাদক মুজতবা দানিশ, চিফ আউটপুট এডিটর লোপা আহমেদ ও অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর খান মুহাম্মদ রুমেল। আরেক দফা চাপ আসে ১৮ ডিসেম্বর, যখন রাজনৈতিক নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সিটি গ্রুপের এমডির সঙ্গে দেখা করে ১০ জনের নাম সম্বলিত একটি তালিকা দেন এবং তাদের চাকরিচ্যুতির জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ মব ভায়োলেন্সের হুমকি দেন। একই দিন তালিকাভুক্ত পাঁচজনকে পদত্যাগ করতে বলার পর হোয়াটসঅ্যাপে তাদের বরখাস্তের নোটিশ পাঠানো হয়।
গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়নের আরেক দৃষ্টান্ত দেখা যায় ২৯ এপ্রিল, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব ঘিরে। পরদিন দীপ্ত টিভি তাদের প্রধান খবরের বুলেটিন বন্ধ রাখে এবং সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট মিজানুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করে। একই ঘটনার জেরে এটিএন বাংলা বরখাস্ত করে ফজলে রাব্বীকে এবং চ্যানেল আই অব্যাহতি দেয় রিপোর্টার রফিকুল বাসারকে।
একের পর এক এসব ঘটনায় প্রতীয়মান হচ্ছে, সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ১৬৭ জন সাংবাদিকের এক্রিডিটেশন বাতিল করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা এইচআরডব্লিউ জানায়, জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে ১৪০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয় এবং ১৫০ জনের অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে ১৯ জনের বিরুদ্ধে।
এ পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে প্রচারেও ব্যবহার হচ্ছে মিডিয়া। ঈদুল আজহার দিনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে এক ব্যক্তির “স্যার, আপনাকে পাঁচ বছর চাই” বক্তব্য ছিল সুপরিকল্পিত। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সাজানো নাটক। ভিডিওটি শফিকুল ইসলাম নামের এক কর্মকর্তা পোস্ট করার পর গণমাধ্যমে তা জোরপূর্বক ছড়ানো হয়।
এই দৃশ্যমান কৌশল মূলত জনসমর্থন তৈরি ও আস্থা পুনরুদ্ধারে এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। ধর্মীয় উৎসব ও ঈদগাহের মতো পবিত্র মঞ্চ ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের এই প্রচেষ্টা সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
সাংবাদিকরা আজ স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতে ভয় পান। চাকরি হারানো, মামলা, তদন্ত, হেনস্তা কিংবা লাইসেন্স বাতিলের ভয় তাদের বাকরুদ্ধ করে রাখছে। এর ফলাফল শুধু মিডিয়ার নয়—গণতন্ত্রেরও।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম আজ আর কেবল সত্য তুলে ধরার মাধ্যম নয়—তা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক চাপ, ভয়ের সংস্কৃতি ও নিয়ন্ত্রণের শিকার এক পরনির্ভর প্ল্যাটফর্ম। যেখানে প্রশ্ন করার অপরাধে সাংবাদিককে চাকরি হারাতে হয়, সেখানে স্বাধীনতা কেবল এক অলীক ধারণা।
ইউনূসের শাসনামলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আজ বিপর্যস্ত : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর বাংলাদেশ এক নতুন বিপজ্জনক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে—শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, দেশের সাংস্কৃতিক নিদর্শন, আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এক সংগঠিত হামলা চলছে। এসব হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এগুলো আদর্শিকভাবে চালিত। মব দিয়ে এসব হামলা করানো হচ্ছে। এ নিয়ে ইউনূস প্রশাসনের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
“নিরপেক্ষতা” ও “সংস্কার”-এর অঙ্গীকার দিয়ে শুরু হওয়া এ সরকার এখন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি এবং অতিরক্ষণশীল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জন্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বহুত্ববাদী মূলনীতির বিরুদ্ধে এক আদর্শিক যুদ্ধের ঢাল।
সুফি মাজারের ওপর একের পর এক আক্রমণ : বাংলার আধ্যাত্মিক প্রাণসত্তা—সুফি মাজারগুলো—যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক ছিল, সেগুলো এখন জনসমক্ষে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। নর্থ ইস্ট নিউজের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০৫টিরও বেশি সুফি মাজার হামলার শিকার হয়েছে।
শিল্প, সিনেমা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন: বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোও ছাড় পায়নি। আগস্ট ২০২৪ থেকে শুরু করে সিনেমা হল, ভাস্কর্য, আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি নানা জায়গায় হামলা হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির সমর্থকরা এসব স্থাপনায় আগুন লাগিয়েছে বা ভাঙচুর করেছে। দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, জাতীয় চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য , শশী লজের ভেনাস মূর্তি অপসারণ বা বিকৃত করা হয়েছে।
সমাজসচেতন চলচ্চিত্র প্রদর্শনকারী সিনেমা হলগুলোও হামলা বা হুমকির মুখে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ এক নতুন ধরণের সেন্সরশিপ—ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া, শিল্পীদের কণ্ঠরোধ করা।
ধানমন্ডি ৩২-এর করুণ পরিণতি: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি-বিজড়িত ঐতিহাসিক বাসভবন ধানমন্ডি ৩২-এর ওপর হামলা জাতিকে সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত দুইবার হামলার পর, অবশেষে এটি জুলাই আন্দোলন ও এনসিপি কর্মীদের নেতৃত্বে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পুলিশ ঘটনার সময় উপস্থিত থাকলেও কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি।
প্রেস এক্সপ্রেস এবং দ্য ওয়্যার-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই হামলা ছিল পরিকল্পিত। প্রবাসী ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য সামাজিক মাধ্যমে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে একে “আওয়ামী শাসনের প্রতীকের অপসারণ” হিসেবে তুলে ধরেন। অথচ ইউনূস প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল—নির্বাক।
না কোনো গ্রেপ্তার, না তদন্ত, না কোনো রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা। যেন বার্তা একটাই—বাংলাদেশের ইতিহাস এখন দর কষাকষির বস্তু, জনরোষের বলি।
রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারও রক্ষা পাচ্ছে না: ২০২৫ সালের ১২ জুন সিরাজগঞ্জে অবস্থিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বাড়ি, কাচারি বাড়ি জাদুঘর, একদল উগ্রবাদী দ্বারা ভাঙচুরের শিকার হয়। নোবেল বিজয়ী এই কবির অবস্থান ধর্ম-বর্ণ-সীমার ঊর্ধ্বে হলেও, তার ওপর অভিযোগ এসেছে "হিন্দু সাংস্কৃতিক আধিপত্য" ছড়ানোর। ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, জাদুঘরটি বন্ধ করে "প্রাথমিক তদন্ত" শুরু করা হয়েছে—যেটা কার্যত এক অর্থহীন প্রক্রিয়া।
মব উস্কে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের চেষ্টায় ইউনূস গং: অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের চেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে অস্থিরতা, যেখানে শিক্ষকরা হচ্ছেন নির্যাতনের শিকার এবং জোর করে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন শিক্ষক হয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে শিক্ষকরাই সবচেয়ে অবহেলিত হয়ে পড়েছেন। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিভিন্ন অজুহাতে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করছে, যা শিক্ষক সমাজের আত্মমর্যাদায় বড় ধাক্কা দিয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, প্রায় দুই হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার শিক্ষক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রায় ৫ শতাধিক আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মিথ্যা-মামলার কবলে পড়ে অনেকে জেল-হাজতে আছেন। তারা পদ-বঞ্চিত হয়ে বেতন-ভাতাদি না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। দেশজুড়ে এমন ঘটনায় বিবেকবান মানুষ বিস্মিত ও স্তম্ভিত।
শিক্ষকদের অভিযোগ, সরকার পতনের পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা তাদের বিস্মিত করেছে। পদত্যাগের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা সামনে থাকলেও নেপথ্যে রয়েছে ভিন্ন কারণ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক পদগুলো দখল করতেই শিক্ষকদের আরেকটা অংশই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। অথচ কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও যথাযথ প্রক্রিয়া আছে। সেসবের কোনোটিই অনুসরণ না করে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। কোথাও দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে শিক্ষকদের। শিক্ষকতার শেষ বয়সে এসে সম্মান হারাতে হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও হুমকিস্বরূপ। অনেক শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে ফিরতে চান; কিন্তু আতঙ্কে যেতে পারছেন না।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব ঘটনার পেছনে একটি সুপরিকল্পিত মব উস্কে দেওয়ার কৌশল কাজ করছে, যার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা হচ্ছে। এতে একদিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নামে পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষকের মর্যাদা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
আবাসন ভাতা, হল নির্মাণ ও জকসু রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে (উপাচার্য ভবন) তালা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গত মে মাসের ৭ তারিখ শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সুচিতা শরমিনকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা তার সরকারি বাসভবনের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, অবিলম্বে ভিসি পদত্যাগ না করলে অনশনসহ বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলে কর্মসূচি ছড়িয়ে দিয়ে অঞ্চল অচল করে দেওয়া হবে।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) দীর্ঘ আন্দোলনের পর উপাচার্য পদে পরিবর্তন এলেও একাডেমিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। নতুন উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর ৪ মে ক্লাস শুরুর কথা থাকলেও শিক্ষকদের ক্লাস বর্জনের কারণে এখনো কোনো শ্রেণির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। এতে সেশনজটসহ নানা সংকটে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
২৬ এপ্রিল রাতে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য, অনুষদের ডিন এবং বিভাগীয় প্রধানরা একযোগে পদত্যাগ করেছেন। ফেসবুকেরে এক পোস্টে ইউআইইউ জানিয়েছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অযৌক্তিক দাবির প্রতিবাদে উপাচার্য, সকল ডিন, প্রধান এবং পরিচালকরা যৌথভাবে তাদের প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
ছয় দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে সারা দেশের পলিটেকনিক কলেজগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে একাডেমিক কার্যক্রম। সম্প্রতি তারা মহাসড়ক অবরোধ করে পুরো রাজধানীবাসীকে যানজটে নাকাল করেছেন। গত বুধবার (৭ মে) বিকালে চলমান পূর্ণাঙ্গ শাটডাউন কর্মসূচি শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণ ও পরীক্ষা বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার পর আবার বিদ্যালয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নরোত্তমপুর ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মারধরের শিকার হয়েছেন। মারধরের পর পরনের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। মারধরের শিকার ওই শিক্ষকের নাম ইউনুস নবী। এছাড়া গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভা এলাকায় বাগধানী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোসা. মঞ্জু মনোয়ারাকে মেরে চেয়ার গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা।
সারা দেশে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো সহস্রাধিক শিক্ষক এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে রয়েছেন। এসব ঘটনায় ৬ জন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। এমন পরিস্থিতির শিকার সারাদেশে ২৪০ জন শিক্ষক। এরমধ্যে ১৮৮ জনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ১১২ জনকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছেন না ৫৯ জন। আর জোর করে অবসরে পাঠানো হয়েছে ১৭ জনকে। এছাড়া ১৮৮ জনের মধ্যে প্রায় ১০০ জনের বেতন বন্ধ রয়েছে। বেতন-ভাতা না পেয়ে তারা কষ্টে জীবন-যাপন করছেন বলেও জানা গেছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এসব শিক্ষকের সমস্যা সমাধান করার কথা বললেও বিষয়টি ঝুলে আছে।
শিক্ষকদের পদত্যাগ করানোর খবরগুলোর মধ্যে দেশজুড়ে আলোচিত ছিল নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের বিষয়টি। গত ৩০ আগস্ট তার বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হয়। একদল শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরাও অবরুদ্ধ করে অধ্যক্ষকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের কটূক্তি এবং চাপের মধ্যে এক পর্যায়ে তাকে পদত্যাগপত্রে সই করতে দেখা যায়। হঠাৎ করেই তিনি বুকে চেপে ধরে শুয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে ধরাধরি করে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
৫ আগস্টের পর চট্টগ্রামের হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুবের ওপর হামলা ও জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন প্রতিষ্ঠানটির কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি জনপ্রিয় ও শিক্ষার্থীবান্ধব হিসাবে সমাদৃত ছিলেন। যার ফলে শিক্ষকের মৃত্যুর খবরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
মিরপুরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মডেল একাডেমির প্রধান শিক্ষক শুভাশীষ কুমার বিশ্বাস বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি গুণগত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার স্বীকৃতি হিসেবে দুইবার দেশসেরার পুরস্কার পান। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রোষানলে পড়েন তিনি। গত ৬ অক্টোবর নিজ অফিসকক্ষে প্রায় ১২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখ হয় তাকে। পরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৯ শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জনকে সপদে বহাল করা সম্ভব হয়। গত ২ নভেম্বর ২৩ নভেম্বর সরকার পতনের পর ‘পদত্যাগে বাধ্য’ করার দুই মাস পর ‘হৃদরোগে’ মারা গেছেন চট্টগ্রামের বেসরকারি হাজের-তজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুব। গত ডিসেম্বরে পদত্যাগে বাধ্য করতে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাজেমহল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভীন বেগমকে (৫৪) মারধর করা হয়।
গত ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী এলাকায় “মব” সৃষ্টি করে হাজী তোবারক আলী চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য। গত ২৫ এপ্রিল পদত্যাগপত্রে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়ার পর আবার বিদ্যালয়ে যাওয়ায় নোয়াখালীর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় তাঁর পরনের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয় বলে শিক্ষকের অভিযোগ।মারধরের শিকার ওই শিক্ষকের নাম ইউনুস নবী।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে একটি জ্ঞানবিমুখ, বিশৃঙ্খল প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যা পুরো জাতির জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্গতি : ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিটি স্তরে সংকটে নিমজ্জিত। শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখতে উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে — শিক্ষক নিয়োগ, পরীক্ষা পুনর্গঠন, সংস্কার কমিশন গঠন—কিন্তু শৃঙ্খলা ও মান-উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বরং পুরনো যান্ত্রিক শিক্ষায় ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি, শিক্ষক ও ছাত্রদের স্বার্থহানির অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবনতি—এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাস্তব সংস্কার ছাড়া শিক্ষাভবিষ্যৎ সংকটে যাচ্ছে।
২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সব না হলেও কিছু বই বছরের প্রথম দিনই উঠত শিক্ষার্থীদের হাতে। এবার স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৪১ কোটি বিনামূল্যের বই ছাপানো কথা বললেও বাস্তবে নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে ৬ কোটি বই। বাকি ৩৫ কোটি সময়মতো যায়নি।
পরীক্ষা প্রক্রিয়ার বিশৃঙ্খলা: একদল শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে। শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, সম্পূর্ণ পরীক্ষা নেয়া ছাড়া এভাবে ফলাফল ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারেই দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষার সর্বস্তরে এমনকি কর্মজীবনে প্রবেশেও জটিলতা তৈরি হবে। স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল না করে বরং প্রয়োজনে পরীক্ষার্থীদের আরো সময় দেয়া, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করাসহ নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন শিক্ষকরা।
একইসাথে সামগ্রিকভাবে সব শিক্ষার্থীর জন্য পরীক্ষা বাতিল না করে, বিশেষ করে যেসব পরীক্ষার্থী আন্দোলনের সময় গুরুতর অসুস্থ বা চিকিৎসাধীন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষা গবেষকরা। এছাড়া ক্লাস ও পরীক্ষা স্থবিরতা: আগস্টের পর থেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে চালু হয়নি। নিয়োগ ও প্রশাসনিক সংকট: মাউশি–সহ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সংস্থায় শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘ শূন্যতা থেকে চলতি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এদিকে মধ্যরাত হলেই দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয় একটি সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা চক্র। তাদের স্ট্যাটাসে অস্থিরতা তৈরি হয় বাংলাদেশে। এই চক্রের নেতৃত্বে আছেন কনক সারওয়ার, পিনাকী ভট্টাচার্য ও ইলিয়াস হোসেন—তিনজনই বিদেশে অবস্থানরত ও বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত।
তাদের ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে রাত গভীর হলেই শুরু হয় রাষ্ট্রবিরোধী গুজব, প্ররোচনা এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা। আর এই বিভ্রান্তিকে চূড়ান্ত রূপ দিতে বসে থাকে সুযোগ সন্ধানী একদল মানুষ। যারা এসব স্ট্যাটাস শেয়ার দিয়ে খেপিয়ে তোলে মানুষকে। আর এরপর থেকে শুরু হয় মব। ওইদিকে সরকারও থাকে নির্বিকার। ভাঙচুর-সংঘাতের পর নাম মাত্র বিবৃতি দিয়ে পার পেয়ে যায় তারা। এটি এখন বাংলাদেশের চিত্র।
বিশ্লেষকদের মতে,এটি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, বরং একটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহমূলক প্রচেষ্টা, যেখানে সামাজিক বিভ্রান্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।”
দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা নতুন কিছু নয়, তবে যখন সেটি একটি সংগঠিত চক্রান্তে রূপ নেয়, তখন তা গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ইউনূস গংয়ের বিরুদ্ধে যেভাবে ‘মব উস্কানি’ দিয়ে জাতীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্টের অভিযোগ উঠেছে, তা শুধু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য নয়, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্যও হুমকি স্বরূপ। আইন ও বিচারব্যবস্থার আশ্রয়ে থেকে এই ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি, যাতে কোনো গোষ্ঠী ভবিষ্যতে আর রাষ্ট্রবিরোধী নীলনকশা আঁকার সাহস না পায়।