নিজস্ব প্রতিবেদক
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সঙ্গে থাকা ব্যাগে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র একে-৪৭ এর একটি অ্যামোনেশন ম্যাগজিন উদ্ধার হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। রোববার (২৯ জুন) সকালে প্রি-বোর্ডিং স্ক্রিনিংয়ের সময় ম্যাগজিনটি শনাক্ত করে কর্তৃপক্ষ। তবে এ বিষয়টিকে পরে হালকা করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
ঘটনার সময় আসিফ মাহমুদ তার্কিশ এয়ারলাইন্সের টিকে-৭১৩ নম্বর ফ্লাইটে তুরস্ক হয়ে মরক্কোর মারাক্কেশে যাচ্ছিলেন, যেখানে তিনি ওআইসি ইয়ুথ ক্যাপিটাল ২০২৫ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা ছিল। বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ জানান, "ম্যাগজিনটি শনাক্তের পর আসিফ মাহমুদ বিষয়টিকে ‘ভুলবশত লাগেজে চলে এসেছে’ বলে ব্যাখ্যা দেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন। পরে তিনি ম্যাগজিনটি প্রোটোকল অফিসারের কাছে হস্তান্তর করেন।"
একে-৪৭ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। আর অ্যামোনেশন ম্যাগজিন হলো একধরনের ডিভাইস, যা আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য গুলি সংরক্ষণ এবং সরবরাহের কাজ করে। এটি বন্দুকের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা থেকে গুলি চেম্বারে পৌঁছে যায়। ম্যাগজিন একাধিক ধরনের হতে পারে—বন্দুকের ভিতরে স্থায়ীভাবে যুক্ত অথবা আলাদাভাবে সংযুক্তযোগ্য। এই ধরনের সামগ্রী আন্তর্জাতিক ভ্রমণে উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয়।
আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল আসিফ
বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য আবেদনকারীর বয়স ন্যূনতম ৩০ বছর হতে হবে। আর আসিফের এই বয়স হতে এখনও বাকি ৪ বছর।
যদিও তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অস্ত্র রাখার পেছনে নিজের নিরাপত্তার কথা তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি লেখেন, নিরাপত্তার স্বার্থে আমার লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্র আছে। গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের উপরে যেভাবে হত্যাচেষ্টা চালানো হয়েছে কয়েকদফা তাতে রাখাটাই স্বাভাবিক। যখন সরকারি প্রোটোকল বা সিকিউরিটি থাকে না তখন নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে লাইসেন্সড অস্ত্র রাখা।
মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিতব্য 'ওআইসি ইয়ুথ ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামে' অংশগ্রহণের জন্য আজ ভোর ৬.৫০ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। ভোরে প্যাকিং করার সময় অ*স্ত্র সহ একটা ম্যাগজিন রেখে আসলেও ভুল বশত আরেকটি ম্যাগজিন ব্যাগেই রয়ে যায়। যেটা স্ক্যানে আসার পর আমার প্রোটোকল অফিসারের কাছে হস্তান্তর করে আসি। বিষয়টি সম্পূর্ণ আনইন্টেনশনাল। শুধু ম্যাগজিন দিয়ে আমি কি করবো ভাই? ইন্টেনশন থাকলে অবশ্যই অস্ত্র রেখে আসতাম না। এখানে অবৈধ কিছু না থাকলেও অনেকের জন্যই এটা আলোচনার খোঁড়াক বটে।
তবে চাপ দিয়ে নিউজ সরানোর অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই ঘটনার পর আমি টিমসহ টানা ১০ ঘন্টা ফ্লাইটে ছিলাম। ট্রানজিটে নেমেও দীর্ঘক্ষণ পর অনলাইনে এসে দেখতে পাচ্ছি যে এতকিছু ঘটেছে। নাগরিক হিসেবে আপনারও যদি নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে, যথাযথ নিয়ম ফলো করেওআপনিও অস্ত্রের লাইসেন্স করতে পারেন।
এই স্ট্যাটাসে বলেছেন, কেউ চাইলে এখন থেকে যে কোনো বয়সে অস্ত্র রাখতে পারবেন। অর্থাৎ আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন আসিফ।
সূত্র বলছে,অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, আদালতে মব তৈরি করে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে আসিফ। সম্প্রতি কুমিল্লায় মুরাদনগরে হিন্দু নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেখানেও তাঁর ওপর অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। কারণ কুমিল্লার ঘটনায় মব থাকলেও তারা ধর্ষককে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। সূত্র বলছে, এরসঙ্গে এই আসিফের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
আসিফের ব্যাগে একে-৪৭ রাইফেল পাওয়ার খবরে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদল ও জুলাই আন্দোলনের সময় ব্যবহৃত মারণাস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন একসময় উল্লেখ করেছিলেন, "জুলাই আন্দোলনে সাধারণ নাগরিকের হাতেও ৭.৬২ রাইফেল আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।" এরপরই তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আসিফের সঙ্গে হিজবুত তাহরীর ও শিবির সম্পর্কের খবর নতুন নয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী জুলকারনাইন তার ফেসবুক জানান, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। আর এই এজাজকে নিয়োগ দিয়েছিলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদই। এজাজ ছাত্র জীবনে ইসলামি ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, ২০০২ সাল থেকে হিজবুত তাহরীরের সাথে জড়িত হন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আসিফ মাহমুদের ব্যাগে একে-৪৭-এর অ্যামোনেশন ম্যাগজিন পাওয়া যাওয়াটা নিছক ‘ভুল’ হিসেবে দেখলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হালকাভাবে নেওয়া হবে। এটি শুধু একটি বিমানবন্দরে অস্ত্র বা ম্যাগজিন বহনের প্রসঙ্গ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, রাজনৈতিক আন্দোলন, এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য পুনঃউত্থানেরও ইঙ্গিত বহন করে।
যে ব্যক্তি এখনো আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য আইনগতভাবে যোগ্য নন, তিনি কিভাবে এমন অস্ত্রের মালিক হলেন—এ প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রকেই খুঁজে বের করতে হবে। শুধু ভুল বলে দায়মুক্তি পাওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে যদি তিনি স্বীকার করেন যে নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি অস্ত্র বহন করেন—তাহলে সেটা আরও উদ্বেগের।
এ ঘটনাটি আরও গভীর প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে—বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগের আলোকে। অতীতে সাধারণ নাগরিকদের হাতেও যে অস্ত্র ছিল তা যদি সত্য হয়, তাহলে এর যোগানদাতা কারা, তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কী, এবং তার সঙ্গে আসিফ মাহমুদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা—তা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ করা দরকার।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আসিফের সঙ্গে পূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোষ্ঠী যেমন হিযবুত তাহরীর বা ছাত্র শিবির সংশ্লিষ্ট কারো ঘনিষ্ঠতা থাকাটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে। রাষ্ট্র যখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে থাকে, তখন এ ধরনের অস্ত্র ও চরমপন্থী সংশ্লিষ্টতা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।”