নিজস্ব প্রতিবেদক
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ধোঁকায় পড়ে জুলাই আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া অনেকেই তখন ভেবেছিল দেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন আনবেন তিনি। তবে তার শাসনামলে একদিকে যেমন বেড়েছে দুর্নীতি, অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও নাজুক হয়েছে। আর এখন এসবে দিশেহারা দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী সমাজ।
সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টকশোতে এসে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষ আশা করেছিল জীবনটা সহজ হবে, কিন্তু এখন ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, ইনফ্লেশন কমছে না, বরং কাজ হারিয়ে ফেলার ভয় বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাবে। অর্থনীতির এই ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মূল কারণই হচ্ছে বিনিয়োগহীনতা ও দুর্বল নীতি।
অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসার পর অধ্যাপক ইউনূস একের পর এক আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি বরং শিল্পপতিরা মনে করছেন, তার নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ দেশি শিল্প ধ্বংসে ভূমিকা রাখছে।
গত এপ্রিলে গুলশানে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, আর ২০২৫ সালে হত্যা করা হচ্ছে উদ্যোক্তা ও শিল্পকে। তিনি গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার এবং আমদানিনির্ভর নীতিমালাকে দায়ী করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “একদিকে গ্যাস নেই, অন্যদিকে কারখানা চালাতে না পারলেও সুদের চাপ বাড়ছে। তিন মাস সুদ না দিলে ব্যাংক ঋণখেলাপি বানিয়ে দিচ্ছে। তার মতে, বিডা বড় বিনিয়োগের কথা বললেও বাস্তবতার সঙ্গে সেগুলোর কোনো মিল নেই। উৎপাদনে যেতে পাঁচ বছর সময় লাগে—এই বাস্তবতায় কেউ বিনিয়োগে আসবে না।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন ২০২৫’-এ বিনিয়োগ আকর্ষণের নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে বিনিয়োগ কমেছে ৭০ শতাংশের বেশি। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৫ সালে অতিরিক্ত ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের মুখে পড়তে পারে।
মূল্যস্ফীতির থাবা
দেশে মূল্যস্ফীতির হার, বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক। এ অভিমত বিশ্ব ব্যাংকের। গত ডিসেম্বরে ঢাকায় আইএমএফের গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপা জর্জি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। দীর্ঘদিনেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতি, যা আইএমএফের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে সংস্থাটি শঙ্কিত’। এই অবস্থায় আইএমএফের চাপে মার্কিন ডলারের মূল্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণে পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাবে। খাদ্য পণ্যের মূল্য অধিক হওয়ায় দেশের বেশিরভাগ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে।
অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিস্তার
নতুন সরকার আসার পর মাত্র ১০ মাসে ২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যা অতীতের দুর্নীতির সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের নিয়োগ পাওয়া সহকারী আতিক মুর্শেদের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ। একই সঙ্গে তার স্ত্রী ‘নগদ’-এ চাকরি পাওয়ার বিষয়টি স্বার্থের সংঘাত হিসেবে সমালোচিত হচ্ছে।
ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সহকারী মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছে টেন্ডার বাণিজ্য ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তথ্যমতে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট (STR) জমা পড়েছে ২৭ হাজার ১৩০টি, যা গত বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি।
কারখানা বন্ধ, কর্মহীনতা বাড়ছে
জাতীয় দৈনিক মানবজমিন-এর তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৪-এর পর থেকে শতাধিক কারখানা স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এর পেছনে দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে সরকার
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতির চিত্র। গত ডিসেম্বরে আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ ক্রিস পাপা জর্জি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ভয়াবহ চাপে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় আমরা গভীর উদ্বেগে রয়েছি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনূসের সরকার এখনো প্রচারণানির্ভর উন্নয়ন নীতিতে আস্থা রাখছে, বাস্তবসম্মত সংস্কারের দিকে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ, দেশি শিল্প বিপর্যস্ত এবং সাধারণ মানুষ বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের দোলাচলে দিন কাটাচ্ছে।
রাজনীতির পরিবর্তনে মানুষ স্বচ্ছতা ও স্বস্তি চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা রূপ নিচ্ছে দুর্নীতির মহাসড়কে। প্রশ্ন উঠছে—এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দায় নেবে কে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই দুর্নীতির রোড রেসে থামবে কে?