এম, কে শাওন; দ্য বেঙ্গল ভয়েস
২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় ২২ জন নিহত হন, যার মধ্যে ১৭ জনই বিদেশি নাগরিক ছিলেন। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ISIS) এ হামলার দায় স্বীকার করে। এই হামলা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে এনেছিল এবং তা এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
কিন্তু এই ঘটনার ৯ বছর পূর্তির দিনে, ২০২৫ সালের ১ জুলাই, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বর্তমান কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “জঙ্গি নাই, এখন ঠেকাতে হবে ছিনতাই। জঙ্গি থাকলে না জঙ্গি নিয়ে ভাববো? আওয়ামী লীগের সময় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ছেলেপেলেদের মারছে, কিসের জঙ্গি?” তার এই বক্তব্য মুহূর্তেই দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। প্রশ্ন উঠে—যেখানে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন এ হামলার দায় স্বীকার করেছে, সেখানে দায়িত্বশীল একজন পুলিশ কর্মকর্তা কীভাবে এতটা হালকা ভাষায় জঙ্গি ইস্যুকে অস্বীকার করতে পারেন?
এই বক্তব্যের পরপরই পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “জঙ্গি নেই—এ কথা বলা যাবে না। তবে এই মুহূর্তে তাদের খুব বেশি তৎপরতা নেই। যারা জামিনে ছাড়া পেয়েছে, তারা আমাদের নজরদারির মধ্যে আছে।” এই বক্তব্য ডিএমপি কমিশনারের অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি বিপরীত। একদিকে কমিশনার বলছেন “জঙ্গি নাই”, অন্যদিকে আইজিপি বলছেন, তারা এখনো সক্রিয় এবং নজরদারির আওতায় রয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আরও উদ্বেগ তৈরি করেছে মালয়েশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা। মালয়েশিয়ার সরকার ২০২৫ সালের জুন মাসে ৩৬ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে, যারা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে সন্দেহ করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার উৎখাতের পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষ্কারভাবে বলেন, তারা আইএস-এর মতাদর্শ ও কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ সে দেশে তরুণদের আইএসে রিক্রুট করছিল।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, হোলি আর্টিজান হামলার দায় স্বীকার করা, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি আইএস সদস্যদের ধরা পড়া, দেশে জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে সতর্কতা—এই সমস্ত কিছু যখন স্পষ্ট, তখন একজন প্রশাসনিক প্রধান কীভাবে প্রকাশ্যে “জঙ্গি নাই” দাবি করতে পারেন? তার এই বক্তব্য কি দায়িত্বজ্ঞানহীন, না কি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যেভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে একটি তথাকথিত ট্রানজিশনাল সরকার গঠন করা হয়েছে, এবং সেই সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন জঙ্গিদের উপস্থিতিকে অস্বীকার করে, তখন তা নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির ইঙ্গিত দেয়। হোলি আর্টিজান হামলার মতো ঘটনায় যেখানে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী নিজেই দায় স্বীকার করেছে, সেখানে সেই ঘটনার গুরুত্ব অস্বীকার করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে “জঙ্গি নাটক” তকমা দেওয়া, এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক বিপথগামিতার দৃষ্টান্ত।
সরকারি প্রশাসনের ভেতরে যদি কেউ চরমপন্থী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেয়, বা জঙ্গিবাদকে হালকাভাবে দেখে—তাহলে তা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। “জঙ্গি নাই” বলা মানে শুধু বাস্তবতাকে অস্বীকার নয়, এটি একটি বিপজ্জনক বার্তা—যা জঙ্গিদের জন্য নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পারে।
এই অবস্থার আলোকে এখন সময় এসেছে সরাসরি প্রশ্ন তোলার—ডিএমপি কমিশনারের এই বক্তব্য কি জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতি কোনও নীরব সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এই সরকার কি চরমপন্থীদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছে? আর যদি তাই হয়, তবে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়িয়ে?