নিজস্ব প্রতিবেদক
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশে মিথ্যা মামলা দায়েরের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলার অপব্যবহার হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব মামলার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান না নিয়ে বরং নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ-এর ফুলবাড়ীয়া এলাকার সোলায়মান সেলিম নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, তাকে “মৃত দেখিয়ে” একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ তার ঠিকানায় তদন্তে গেলে তিনি নিজেই ‘ভুয়া মৃত্যু’ ও মামলার কথা জানতে পারেন। নিজের জীবনের নিরাপত্তার আশঙ্কায় তিনি স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
ঘটনাটি ঘটে ৩ আগস্ট, ঢাকার কাজলা এলাকায় গুলির ঘটনা দেখিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী সেলিমের বড় ভাই। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা-কে। অন্যান্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শামীম ওসমান সহ আরও ৪১ জন, এবং অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ১৫০-২০০ আওয়ামী লীগ কর্মী।
এর আগে, ১৭ অক্টোবর খিলগাঁও থানায় জহিরুল ইসলাম খান পান্না (জেড আই খান পান্না)-এর বিরুদ্ধে একটি ভুয়া হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহাদুল ইসলামকে গুলি ও মারধর করে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু মামলার বাদী মো. বাকের সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করেন যে, তিনি পান্নাকে চেনেন না এবং মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে তাও জানেন না। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে পান্না জামিন পান।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে রবি দাস নামে এক মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে। ৬৪ বছর বয়সী এই মুচি ১৮ জুলাই স্ট্রোক করে মারা যান। কিন্তু তার মৃত্যুকে ঘিরে ২৯ নভেম্বর একটি মামলা দায়ের করা হয়—যেখানে অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তাকে হত্যা করেছে। মামলায় ৪৫০ জনেরও বেশি আসামি করা হয়, যার মধ্যে ১৬৮ জনের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, এমনকি শেখ হাসিনার নামও সেই তালিকায় রয়েছে। দুলালের ছেলে বিকাশ দাস বলেন, "আমরা চাই না কেউ আমার বাবার নাম ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করুক।"
এছাড়াও, ২৭ অক্টোবর ফেনীতে দায়ের হওয়া একটি মামলায় ৮৫ জনকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে রয়েছেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। মামলায় ঢাকায় বসবাসরত ব্যবসায়ী ইব্রাহিম পাটোয়ারীকেও আসামি করা হয়, যিনি আদালত থেকে জামিন পান। ইব্রাহিম বলেন, "আমি ওই সময় ফেনীতে ছিলাম না। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে কোনো আন্দোলনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।"
মানবাধিকার সংগঠন ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন এবং বিরোধীদের হেয়প্রতিপন্ন করা। সুপ্রিম কোর্ট এর আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “জুলাই মাসের আন্দোলনের পর দায়ের হওয়া মামলাগুলো এখন দুর্নীতির উৎসে পরিণত হয়েছে। অনেক মামলায় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগেরই কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
তিনি আরও বলেন, “অসংখ্য ব্যক্তিকে আসামি করলে প্রকৃত তদন্ত অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে প্রকৃত অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের পতনের পর ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলা হলেও এসব ঘটনা উল্টো প্রবণতা দেখাচ্ছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, যদি এসব মিথ্যা মামলা ও দমনমূলক কৌশলের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।