নিজস্ব প্রতিবেদক
অর্থপাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তবে এ মামলা নিয়ে এখনও বিতর্ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রমাণ থাকার পরেও অন্তর্বর্তী সরকারের ক্যাঙ্গারু কোর্ট তাদের খালাস দিয়েছে।
টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য নির্মাণ কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা নেন। সিঙ্গাপুরে এ টাকা লেনদেন হয়।
এরপর মামুন ওই অর্থ সিঙ্গাপুরের ক্যাপিটাল স্ট্রিটের সিটি ব্যাংক এনএতে তার নামে ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। এ টাকার মধ্যে তারেক রহমান তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেন বলে অভিযোগ এনে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় এ মামলাটি করে দুদক।
২০১১ সালের ৮ আগস্ট আদালত ২০০২ সালের মানি লন্ডারিং আইনের অধীনে মামলায় তারেক রহমান ও তার ব্যবসায়িক অংশীদার মামুনকে অভিযুক্ত করে এবং তারেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তারের পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনে পালিয়ে যান তারেক। ২০১১ সালের ৬ জুলাই এই মামলার বিচার শুরু হয় এবং ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়, যেখানে মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ৪০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। আর তারেকে খালাস দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তারেকের খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি আপিলটি গ্রহণ করে হাইকোর্ট।
কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে মামুনের আপিলের সঙ্গে দুদকের আপিল শুনানির পর, ২০১৬ সালের ২১ জুলাই হাইকোর্ট মামুনের সাজা বহাল রাখে কিন্তু জরিমানা কমিয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়; একইসঙ্গে তারেককে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়।
কিন্তু, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি আবেদন করেন মামুন। আপিল বিভাগ এই আপিলের অনুমতি মঞ্জুর করে এবং গত বছরের ১০ ডিসেম্বর একটি আদেশ জারি করে। সেখানে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করা হয় এবং আপিলের সারসংক্ষেপও জমা দিতে বলা হয়। এরপর মামুন আপিল করেন।
পরবর্তীতে ৪ মার্চ মামুনের আপিলের শুনানি শেষে ৬ মার্চ রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ, বিএনপির একজন নিয়োগকর্তার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল ঘোষণা করেন এবং তারেক ও মামুনের খালাসের পথ প্রশস্ত করেন।
আদালত বলেন, মামলায় অভিযোগের কোনও সত্যতা বা সারবস্তু নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে মামলাটি যখন দায়ের করা হয়েছিল, সেই সময় তা কার্যকর ছিল না। সম্পূর্ণ হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়।
ডেব্রা আদালতে কী বলেছিলেন?
বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে দুর্নীতির তদন্ত পরিচালনাকারী এফবিআই এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রেভোট সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, নির্মাণ কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলামের সিঙ্গাপুরের ওসিবিসি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে মামুনের সিঙ্গাপুর সিটিব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নং ১৫৮০৫২-০১৬-০০৮-এ ঘুষ লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন তারা। একই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তারেক রহমানের নামে ৪৫৬৮-৮১৭০-১০০৬-৪১২২ নম্বরে একটি সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ড ইস্যু করা হয়েছিল। ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করার সময় তারেকের পাসপোর্টের একটি ফটোকপি (পাসপোর্ট নং ওয়াই ০০৮৫৪৮৩, পিতার নাম মরহুম জিয়াউর রহমান এবং মাতার নাম খালেদা জিয়া) সিটিব্যাঙ্ক সিঙ্গাপুরে জমা দেওয়া হয়েছিল।
এরপর তারেক গ্রিস, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ভ্রমণের জন্য এফবিআই যে ক্রেডিট কার্ডটি খুঁজে পেয়েছিল, তা ব্যবহার করেছিলেন।
মোয়াজ্জম হোসেন, মায়ের চিরে এবং মেরিনা জামানের মতো অন্যরাও মামুনের সিঙ্গাপুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তারেকের কাছে ঘুষের অর্থ স্থানান্তর করেছিলেন, যেখানে তারেকের অ্যাক্সেস ছিল।
আদালতে ঘটনাবহুল দিন
২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর সকাল ১১টা ২০ মিনিটে যখন কার্যক্রম শুরু হয়, তখন মামুনের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ডেব্রার সাক্ষ্যগ্রহণের বিরোধিতা করেন।
তিনি শুনানি স্থগিত রাখার জন্য একটি আবেদন দাখিল করেন, কারণ চার্জশিটে সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়নি এবং চার্জশিটে উল্লিখিত সকল সাক্ষী তাদের জবানবন্দি দেওয়ার পরেই অতিরিক্ত সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে পারবেন।
আবেদনের বিরোধিতা করে দুদকের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক বলেন, অতিরিক্ত সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনও আইনি বাধা নেই। তিনি যুক্তি দেন যে ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৫৪০ ধারায় বলা হয়েছে যে আদালত যেকোনো ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে তলব করতে পারে অথবা যেকোনো ব্যক্তিকে পুনরায় জেরা করতে পারে, এমনকি যদি সেই ব্যক্তিকে আগে তলব না করা হয়, যদি তার সাক্ষ্য মামলার ন্যায্য সিদ্ধান্তের জন্য অপরিহার্য হয়।
বিচারক এরপর আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন এবং ডেব্রার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন। তিনি দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে তার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন।
দুপুরের দিকে এফবিআই এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রেভোট যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন, তখন সেখানে হট্টগোল শুরু হয়। তারেক ও মামুনের পক্ষে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং ফখরুল ইসলাম আদালত বর্জন করে চলে যান। পরে তারা আদালত প্রাঙ্গণে একটি মিছিল বের করেন।
ডেব্রার সাক্ষ্যগ্রহণের পর বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মামুনকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি এফবিআই কর্মকর্তাকে জেরা করতে চান কি না? জবাবে মামুন মাথা নাড়িয়ে না বলেন।
ডেবরা ল্যাপ্রেভোট দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে কাঠগড়া থেকে নেমে আসেন এবং দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়।
সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ডেব্রা বলেন, আমি ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের একজন সুপারভাইজরি স্পেশাল এজেন্ট। আমি ১৬ বছর ধরে একজন এফবিআই এজেন্ট। আমার ফরেনসিক বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং মানি লন্ডারিং কৌশলে উন্নত প্রশিক্ষণ রয়েছে। আমার দেশে সাক্ষ্যদানের উদ্দেশ্যে আমাকে আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিংয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পারস্পরিক আইনি সহায়তার অনুরোধের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার অনুরোধ করে। এ অনুরোধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার সম্পদ পুনরুদ্ধারের মামলাগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের ঢাকায় পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই অনুরোধটি পর্যালোচনা করেছে যাতে নিশ্চিত করা যায় যে এটি রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।
ডেব্রা আদালতকে জানান যে মার্কিন বিচার বিভাগের প্রতিনিধিরা দুদকের সাথে দেখা করার পরপরই তিনি মার্কিন সরকারের অনুমতি নিয়ে তার তদন্ত শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, তদন্তের অংশ হিসেবে আমি সিঙ্গাপুরে বেশ কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বের করেছি। এই অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে আমি সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছি । অ্যাকাউন্টটি গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নামে ছিল। মার্কিন বিচার বিভাগ সিঙ্গাপুরের কাছে পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত নথি চেয়েছিল। আমি ২০০৪ এবং ২০০৫ সালের ১৫৮০৫২-০০৮ এবং ১৫৮০৫২-০১৬ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নথি পেয়েছি। ওই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে দুটি ক্রেডিট কার্ডও খুঁজে পেয়েছি।
ডেব্রা বলেন, অ্যাকাউন্টে প্রথম ক্রেডিট কার্ডটি ছিলমামুনের নামে একটি ভিসা ক্রেডিট কার্ড। মামুনের ভিসা ক্রেডিট কার্ডের নম্বর ছিল ৪৫৬৮৮১৭০০০৬৪১২৪। তারেক রহমানের নামে আরেকটি ক্রেডিট কার্ড ছিল। ওইসময় তিনি তার কাছে থাকা কাগজ থেকে তারেকের নামের অক্ষরগুলি উচ্চস্বরে উচ্চারণ করেন। ক্রেডিট কার্ডের নম্বর ছিল ৪৫৬৮৮১৭০১০০৬৪১২২।
যদিও আপিল বিভাগ বলেছে, মামলাটি দায়েরের সময় কার্যকর মানি লন্ডারিং আইন ছিল না, তবে মামলার বিভিন্ন প্রমাণ, এফবিআইয়ের সাক্ষ্য, সিঙ্গাপুরের ব্যাংক লেনদেন—সবকিছু আদালতে উপস্থাপিত হয়।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের মামলায় যখন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অংশগ্রহণ থাকে, তখন তা পুরোপুরি খারিজ করা হলে সেটি ভবিষ্যতে দুর্নীতি দমনে নেতিবাচক বার্তা দেয়।