নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ যখন জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছিল, তখন ২০২৪ সালের আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তথাকথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সে সরকার আজ জঙ্গিবাদকে ‘রাজনৈতিক সম্পদ’ হিসেবে ব্যবহার করছে— এমনটাই মনে করছেন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সচেতন মহল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নাগরিকরা।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে মালয়েশিয়ায় আটক হওয়া ৩৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ঘিরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়ার পুলিশ এবং নিরাপত্তা সংস্থা এই ব্যক্তিদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা, সন্দেহজনক তহবিল লেনদেন, এবং আন্তর্জাতিক মৌলবাদী চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আটক করে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম কোনো তদন্ত ছাড়াই সাফ জানিয়ে দেন মালয়েশিয়ায় আটক ৩৬ জন জঙ্গি নন।
একটি আধুনিক রাষ্ট্রে যখন বিদেশে আটক নাগরিকদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠে, তখন রাষ্ট্র সেই দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তথ্য সংগ্রহ করে এবং নিজস্ব তদন্তের ভিত্তিতে অবস্থান নেয়। অথচ এখানে দেখা গেল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার তদন্ত বা আইনি প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে একতরফাভাবে আটককৃতদের ‘নির্দোষ’ ঘোষণা করলেন। এটি কেবল কূটনৈতিক দায়িত্বহীনতা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে প্রকাশ্য ছিনিমিনি খেলা।
এই অবস্থানে এসে একটি প্রশ্ন জাতিকে নাড়া দিচ্ছে আসলে কি ইউনূস সরকার জঙ্গিদের রক্ষায় নেমেছে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. ইউনূস সবসময়ই ছিলেন বিতর্কিত। একদিকে যেমন তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তেমনি দেশের ভেতরে তাকে কেন্দ্র করে জামায়াতপন্থি, এনজিও ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশের অভিযোগও উঠে এসেছে।
যখন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে কঠোর অবস্থান নেয়, তখন সেই সময় ড. ইউনূসের অবস্থান ছিল চুপিসারে দ্বৈত ভূমিকার মতো। আর এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর একের পর এক ঘটনা এই অভিযোগকে আরও শক্ত করছে যে, দেশের প্রশাসন এখন জামায়াত-হেফাজত ও মৌলবাদীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে ৩০০-এর বেশি জঙ্গি জামিনে মুক্ত, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এ পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়ায় ৩৬ জন বাংলাদেশিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা 'GRMB' নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে অর্থ ও সদস্য সংগ্রহ করছিল।
পাকিস্তানি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা’র এক নেতা শেখ হাসিনা সরকারের পতনে ভূমিকার কথা বলেছেন, যা বহিরাগত ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত। একইসঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাবেক প্রধানের বক্তব্য উগ্রবাদের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার 'হলি আর্টিজান' হত্যাকাণ্ডকে নাটক বলায় নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমনকি হিযবুত তাহরীরের পোস্টারও সেখানে দেখা গেছে।
৫ আগস্ট ইউনূস সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর জঙ্গি তৎপরতা ও ধর্মীয় চরমপন্থা নতুন মাত্রা পেয়েছে। কাশিমপুর কারাগার থেকে ২০৯ জঙ্গির পলায়ন, প্রকাশ্য 'খেলাফত মার্চ', সংখ্যালঘু নির্যাতন, মাজার-ভাস্কর্য-উৎসবে হামলা এবং নারীদের ওপর সহিংসতা পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। উগ্রবাদ এখন শিশুদের মনেও ঢুকে পড়েছে। প্রশাসনিক শিথিলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা জঙ্গিবাদের পুনরুত্থানে ভূমিকা রাখছে।
বিপদের ঘণঘটা, জঙ্গিবাদ, প্রশাসন ও কূটনীতির মিলন
যে সরকার স্বঘোষিত ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা’র কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের হাতে এখন প্রশাসন, গোয়েন্দা বিভাগ এবং কূটনৈতিক যোগাযোগের শক্তি। এই শক্তি যখন জঙ্গিদের রক্ষায় ব্যবহৃত হয়, তখন তা আর কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয় তা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপব্যবহার।
দেশে ইতোমধ্যেই হেফাজতের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাদ্রাসাগুলোতে উগ্রবাদী চিন্তাধারা পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে, মাঠে-ময়দানে জামায়াতি চক্র সক্রিয় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হামলার শিকার হচ্ছেন আর এসব ঘটনার পেছনে প্রশাসনের ‘নীরবতা’ যেন আরও অনেক কিছু বলে দিচ্ছে।
জাতির সামনে সতর্কবার্তা
মালয়েশিয়ায় আটক ৩৬ জন ‘জঙ্গি নয়’ এমন বক্তব্যের মাধ্যমে ড. ইউনূস সরকারের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। এটি কেবল একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ।
এখন সময় এসেছে দেশপ্রেমিক জনগণের, নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের, এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল শক্তির একত্রিত হবার। কারণ রাষ্ট্র যখন জঙ্গিদের পক্ষ নেয়, তখন জনগণের দায়িত্ব হয় সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারাধীন জঙ্গিদের জামিনে মুক্তি, প্রশাসনের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মের নামে অপপ্রচার—সব মিলিয়ে দেশের সামাজিক বুননকে ক্রমেই দুর্বল করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আগেই সাবধান করেছিলেন, জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় উগ্রতা শুধু সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনেও জায়গা করে নিতে পারে। এবং সেই শঙ্কাই এবার বাস্তবে রূপ নিয়েছে।