নিজস্ব প্রতিবেদক
বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এসএমই) ব্যাংক ঋণ পেতে বেশি সুদ দিতে হয়। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রায়ই দাবি করেন, তারা এসএমইর ব্যবসা সহজ ও কম সুদে ঋণ দেয়াকে অগ্রাধিকার দেয়। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এসএমই বাংলাদেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ‘মেরুদণ্ড’ হিসেবে অব্যাহত আছে। সরকারি হিসাব দেখে উপদেষ্টার কথাকে সঠিক মনে হবে। সারাদেশে এক কোটি ১৮ লাখের বেশি এসএমই আছে। মোট দেশজ উৎপাদনে এই খাতের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষ কাজ করছেন। সেগুলোর ৭০ শতাংশই ঢাকার বাইরে। তা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো এসএমই’র জন্য সুদ নেয় ১৩ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে। এটি সেবা খাত ছাড়া অন্য সব খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে গত এপ্রিলে এসএমইতে ভরিত গড় সুদহার ছিল ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে কৃষিতে এই হার ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ, বৃহৎ শিল্পে ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও সেবা খাতে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এসএমই’র ওপর উচ্চ সুদহার আরোপ করা হয়েছে। সিটি ব্যাংক লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ক্ষুদ্র, মাইক্রোফাইন্যান্স ও এজেন্ট ব্যাংকিং প্রধান কামরুল মেহেদী বলেন, ‘এসএমই ঋণের সুদহার সাধারণত করপোরেট ঋণের তুলনায় দেড় থেকে আড়াই শতাংশ পয়েন্ট বেশি থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকার বাইরের এসএমই গ্রাহকরা থাকায় ব্যবস্থাপনা খরচ বেড়ে যায়।’ তার মতে, এসএমই’তে প্রসেসিং চার্জও আনুপাতিক হারে বেশি। তার মতে, অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে যাওয়া এড়িয়ে চলে। ফলে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে পরিষেবা দেয়ার প্রয়োজন হয় এবং খরচ আরো বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘পরিচালন খরচ বেশি হওয়ায় এসএমই ঋণে অন্যান্য মেয়াদি ঋণের তুলনায় বেশি সুদ দিতে হয়।’ তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সুদহার কমাতে উৎসাহিত করছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো কাজী ইকবাল বলেন, ‘এসএমই ঋণের পরিচালন খরচ বেশি ও ঝুঁকিপূর্ণ।’ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চুয়াডাঙ্গায় এক কৃষি যন্ত্রপাতি ওয়ার্কশপ পরিচালনাকারী ওলিউল্লাহর জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় ১০০ শ্রমিক কাজ করেন। এখানে ভুট্টা মাড়াই ও সরিষার তেল নিষ্কাশনের মেশিন তৈরি হয়। ২০২০ সালে নয় শতাংশ সুদে অগ্রণী ব্যাংক থেকে তিনি পাঁচ কোটি টাকা ঋণ নেন। প্রতি বছর ওলিউল্লাহ প্রতি কোটি টাকার জন্য নয় লাখ টাকা পরিশোধ করতেন। গত বছর সুদের হার ১৪ শতাংশে উন্নীত হওয়ায় তার বার্ষিক ঋণ পরিশোধ বেড়ে হয় ১৪ লাখ টাকা। এক কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটি হঠাৎ করে আমার ত্রৈমাসিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়িয়ে দেয়। এখন ক্রমবর্ধমান সুদহারের সঙ্গে লড়াই করছি।’
গত এক বছর ধরে তার ব্যবসায় মন্দা চলছে। তিনি আশঙ্কা করছেন যে কর্মী ছাঁটাই করতে হতে পারে। নরসিংদীর এক পাট টেক্সটাইল মিলের মালিক অজিত কুমার দাস জানান, পরিবেশ-বান্ধব পাটের ব্যাগের চাহিদা থাকায় তার ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। তবে তিনি বলেন, ‘উচ্চ সুদহার মুনাফা কমিয়ে দিয়েছে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঋণ নেয়ায় প্রচুর খরচ কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা ও ব্যবসার স্থিতিশীলতাকে হুমকিতে ফেলেছে। গত অর্থবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) ঋণ বিতরণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন দশমিক ৪৯ শতাংশ কমেছে। সরকারি তথ্যও এই উদ্বেগের সঙ্গে মিলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে- সেই প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ হয়েছে ৬২ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এসএমই থেকে ঋণ আদায়ের হার ৯৯ শতাংশ। তা সত্ত্বেও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ দিতে চায় না। ব্যবসায়ীরা ঋণ মূল্যায়ন ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোও তুলে ধরে ধরছেন। তাদের ভাষ্যÑ সব ব্যাংকের কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক, গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সীমিত, এসএমই ঋণগ্রহীতা মূল্যায়নে দক্ষতার অভাব ও ঋণ প্রক্রিয়ার খরচ বেশি হওয়াসহ বেশ কয়েকটি কাঠামোগত সমস্যা আছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘পরিচালন খরচ বেশি ও ঝুঁকির কারণে এসএমই সুদহার কম রাখা কঠিন।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য এক লাখ টাকার ঋণ প্রক্রিয়া করতে একটি ব্যাংকের ১০ হাজার টাকা বা মোট ঋণের ১০ শতাংশ খরচ হতে পারে। বিপরীতে ১০০ কোটি টাকার করপোরেট ঋণের প্রক্রিয়া করতে খরচ হয় মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য চার শতাংশ।’
এসএমই ঋণের জন্য শাখা বাড়ানো ও প্রচুর পর্যবেক্ষণ খরচ প্রয়োজন। কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত কর্পোরেট ঋণের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন হয় না।তিনি আরও বলেন, ‘এসব কারণে ব্যাংকগুলো এসএমই থেকে দূরে থাকে ও বাড়তি সুদ নেয়।’
ব্র্যাক ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসএমই ব্যাংকিংয়ের প্রধান আবদুল মোমেন বলেন, ‘বাজারভিত্তিক সুদ ব্যবস্থার আওতায় এই ব্যাংকে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ নেয়া হয়। অন্য অনেক ব্যাংকের তুলনায় তা এখনো কম।’ ব্র্যাক ব্যাংক দেশের অন্যতম শীর্ষ এসএমই অর্থায়নকারী। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া ঋণ ৩২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এদের গ্রাহক আছে প্রায় আড়াই লাখ।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ সুদের হার, প্রচুর জামানতের প্রয়োজনীয়তা ও ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সতর্কতার কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কম খরচে ঋণ পেতে হিমশিম খাচ্ছে।’ এটি সহজ করতে ফাউন্ডেশনটি ২০০৯ সালে ক্রেডিট হোলসেলিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে নয় শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। করোনা মহামারি চলার সময়ে প্রণোদনা তহবিলও দেয়। বিতরণ করা ঋণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এখন নারী উদ্যোক্তারা পেয়ে থাকেন। প্রায় শতভাগ ঋণ আদায়ের হার থাকা সত্ত্বেও অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে উদ্যোক্তার সংখ্যা সীমিত বলে মনে করেন তিনি।
সরকারকে আরো সহায়তার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘প্রায় এক কোটি ১৮ লাখ উদ্যোক্তার ৭০ শতাংশই থাকেন ঢাকার বাইরে। তাই ঋণ বিতরণের পরিসর বাড়ানো দরকার।’