নিজস্ব প্রতিবেদক
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জঙ্গি সংশ্লিষ্ট মামলার শত শত আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন—যাদের মধ্যে বিচারাধীন, সন্দেহভাজন এবং এমনকি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরাও রয়েছেন।
কারা কর্তৃপক্ষ-এর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে অন্তত ৩০০ জনের বেশি জঙ্গি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এতে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক আ ফ ম রেজাউল করীম সিদ্দিকী হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামির জামিনে মুক্তি পাওয়াকে তার পরিবার অত্যন্ত হতাশাজনক বলে অভিহিত করেছে।
রেজাউল করীমের ছেলে বলেন, এর থেকে হতাশাজনক কিছু হতে পারে না… আমরা চাই মা বেঁচে থাকতে থাকতে যেন তার স্বামীর বিচার দেখে যেতে পারেন।”
আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা ও ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত
সম্প্রতি মালয়েশিয়া পুলিশ ‘উগ্র জঙ্গি আন্দোলনে’ জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৬ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে। দেশটির নিরাপত্তা সংস্থা আশঙ্কা করছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশে সরকার উৎখাত চেষ্টায় সম্পৃক্ত থাকতে পারেন।
এছাড়া, পাকিস্তান-এর গুজরানওয়ালা থেকে লস্কর-ই-তৈয়বা-এর এক শীর্ষ নেতা মুজাম্মিল হাজমি দাবি করেছেন, ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে তাদের ভূমিকা ছিল। বিশ্লেষকরা একে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বহিরাগত ষড়যন্ত্রের স্পষ্ট প্রমাণ বলে মনে করছেন।
জামিন ও জঙ্গিদের পুনর্বাসনের বিতর্ক
আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এর সাবেক প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী বলেছেন, বেশিরভাগ লোক নিরপরাধভাবে জেলে ছিল। কেউ ভুল করেও থাকলে, তারা তওবা করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বক্তব্য উগ্রবাদকে বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা।
হলি আর্টিজান ও পুলিশি অবস্থান
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশান এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২০ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশি। হামলার দায় আইএস স্বীকার করলেও, বর্তমান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এই হামলাকে জঙ্গি নাটক বলে অভিহিত করেছেন এবং দাবি করেন এটি আওয়ামী লীগ সরকারের চক্রান্ত ছিল।
প্রতি বছর হোলি আর্টিজান স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণের অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এলাকাটিতে সম্প্রতি নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর-এর পোস্টার দেখা গেছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে গঠিত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় উগ্রতা ও সাংস্কৃতিক নিধনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও উগ্রতার পুরস্কার
চট্টগ্রামে এক বাম ছাত্রজোটের কর্মসূচিতে জামায়াত নেতার মুক্তির দাবিতে অংশ নেওয়া এক ব্যক্তি এক নারীকে প্রকাশ্যে লাথি মারেন। পরে সেই ব্যক্তি জামিনে মুক্ত হয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা পান। একই ধরনের ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা উগ্রতার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠা করছে—যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন
লালমনিরহাট-এ দুই হিন্দু নরসুন্দরকে ইসলাম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে হেনস্তা করা হয়। পরিবারের দাবি, আসলে একটি আর্থিক বিরোধ থেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই অভিযোগ আনা হয়েছে।
জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়া ও শোভাযাত্রা
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ২০৯ জন বন্দির পালিয়ে যাওয়া এবং এর আগে নরসিংদী-তে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা।
একই সময়ে হিযবুত তাহরীর ঢাকায় প্রকাশ্যে ‘খেলাফত মার্চ’ করে, যা আগাম তথ্য থাকা সত্ত্বেও থামাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সাংস্কৃতিক স্থাপনায় হামলা
৫ আগস্ট থেকে তিন মাসে দেশে অন্তত ১০৫টির বেশি সুফি মাজার-এ হামলা হয়েছে। হামলার শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু-র ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি, জয়নুল আবেদিন গ্যালারির ভাস্কর্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কাচারি বাড়ি এবং সিরাজগঞ্জের শশী লজের ‘ভেনাস’ মূর্তি।
উৎসব ও খেলাধুলা বন্ধ
দিনাজপুর ও জয়পুরহাট-এ নারীদের ফুটবল ম্যাচ ‘তৌহিদী জনতা’র হুমকিতে বন্ধ হয়। বসন্ত উৎসব ও বইমেলায় হামলার ঘটনা প্রমাণ করে উগ্রবাদ এখন শুধু ধর্মীয় পরিসর নয়, বরং শিল্প-সংস্কৃতি ও খেলাধুলার প্রতিটি ক্ষেত্রেই হানা দিচ্ছে।
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও তথ্যমন্ত্রী মাহফুজ আলম দাবি করেছেন, “দেশে কোনো জঙ্গি উত্থান ঘটেনি” এবং “চরমপন্থার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।” তবে বিশ্লেষকদের মতে, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা এই বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অস্ত্রধারীদের সক্রিয়তা ও রাষ্ট্রের দুর্বলতা
সম্প্রতি বিমানবন্দরে আসিফ মাহমুদের ব্যাগে এক-৪৭ রাইফেলের গুলি পাওয়া যায়। তাঁর সঙ্গে হিযবুত তাহরীর ও শিবির-এর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন ফেসবুকে জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন-এর বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ, যিনি ছাত্রজীবনে শিবির এবং পরে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাকে নিয়োগ দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
জুলাই মাসের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সময় থাকতে রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে দেশ দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও নিরাপত্তা সংকটে নিমজ্জিত হতে পারে।
মন্তব্য করুন