নিজস্ব প্রতিবেদক
একসময় বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে পরিচিত ছিলেন আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। বর্তমানে তিনি দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিচারবহির্ভূত সহিংসতা ও কথিত মব সন্ত্রাসের পক্ষে তার দেওয়া বক্তব্য নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি এক আলোচিত মন্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মবের ঘটনাগুলো বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের অনাস্থা নয়। বরং গত ১৭ বছরের ক্রোধ। তবে এই ক্রোধ সমীচীন নয়।
তার এই বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা, যারা মনে করেন, বিচার বিভাগের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে এই ধরণের মন্তব্য রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে বৈধতা দেয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘিরে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে মব-সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করে।
টাকা না দিলে আদালত পাড়ায় হয় মব
বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক থাকার সময় আসাদুজ্জামান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমর্থন নিয়েছেন। তারা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ আওয়ামী লীগের নামে বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর মানবাধিকার লঙ্ঘন চলে গেছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। সূত্র বলছে, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রণালয়ে ৬ থেকে ৮ কোটি টাকার লেনদেন না দিতে পারলে মব লেলিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে তাদের ভুয়া মামলা বাণিজ্য তো আছেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের অফিস বরাবরই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে, কিন্তু বাস্তবতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিচার করেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা, যিনি দায়িত্বে আছেন কিন্তু পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকার শর্তে বলেন, মব লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও গড়ে উঠেছে এই অবৈধ লেনদেনের কারণে। যারা আইনি প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে চায়, তারা এই ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবহার করছে। ভুয়া মামলা দায়ের, অপ্রয়োজনে মামলা টানাটানি এবং নির্যাতন অনেক সময় এই আর্থিক লেনদেনের সাথে জড়িত।”
গত ১৩ মে ঢাকা আদালত প্রাঙ্গণে বিচারক মমতাজ বেগমকে ধাওয়া করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আদালত প্রাঙ্গণেই সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক-এর ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা হয়।
এছাড়া সম্প্রতি ঢাকার শেরেবাংলা নগরে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা-র বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে পুলিশকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেলেও হস্তক্ষেপ করেনি তারা। পরে হুদাকেই গ্রেফতার দেখানো হয়।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলার শিকার হয়েছেন অনেক সাধারণ নাগরিক, এমনকি সরকারের প্রাক্তন কর্মকর্তারাও। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বাড়ি ধ্বংস ও গাজীপুরে সাবেক এক মন্ত্রীর বাসায় হামলার ঘটনা এসব সহিংসতার গভীরতা ও বিস্তারের প্রমাণ দেয়।
গবেষণা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হন।
বিশ্লেষকদের মতে, আইনকে পাশ কাটিয়ে বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। তারা বলছেন, এই ধরনের সহিংসতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নয়, বরং সাধারণ নাগরিককেও আতঙ্কিত করছে।”
নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা: সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে
২৯ জুন নারায়ণগঞ্জে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে মহানগর বিএনপির সাবেক এক সহসভাপতিকে বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনা ঘটে।
১৩ মে ঢাকা আদালত প্রাঙ্গণে বিচারক মমতাজ বেগমকে ধাওয়া করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আদালত প্রাঙ্গণেই সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক-এর ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা হয়। সিলেটের জাফলংয়ে সরকারের উপদেষ্টাদের গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভও রাজনৈতিক মব সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা।
হা-মীম গ্রুপের এমডি এ কে আজাদের বাড়িতে চড়াও
৩ জুলাই ফরিদপুরে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ-এর বাড়িতে ‘আওয়ামী লীগের গোপন সভা হচ্ছে’ অভিযোগ তুলে মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। ঘটনাস্থল থেকে মিছিল বের করে বিভিন্ন এলাকায় গমন করে তারা। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কাউকে পায়নি বলে জানিয়েছে।
ঝিকরগাছায় প্রতিবন্ধীকে গাছে বেঁধে হত্যা
২ জুলাই যশোরের ঝিকরগাছায় সরকারি ভাতা বন্ধ হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করায় মানসিক প্রতিবন্ধী রফিকুল ইসলামকে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা। নিহতের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। বরং স্থানীয়রা জানান, তিনি কেবলমাত্র তার ভাতা ফিরে পেতে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
কুমিল্লায় একই পরিবারের তিনজনকে হত্যা
মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে কুমিল্লার মুরাদনগরে এক পরিবারের তিনজন সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা। পুলিশ বলছে, এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের ক্ষোভ এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্ররোচক হিসেবে কাজ করেছে।
বিবস্ত্র করে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে মারধর
২৬ জুন রাতে মুরাদনগরের আরেক গ্রামে ফজর আলী নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে উত্তেজিত লোকজন তাকে ও নির্যাতিত নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করে। এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পুলিশ ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যে ধারাবাহিক ‘মব জাস্টিস’ ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তা কেবল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নয়—বরং এর পেছনে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প কাজ করছে। তারা মনে করছেন, বিএনপি ও ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু অংশ যেন যৌথভাবে এমন এক সহিংস সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধী শক্তিকে দমন, ভীতি ছড়ানো, এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাকে দুর্বল করে তোলা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র; গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। নিরপরাধ মানুষও ফাঁদে পড়ে মারধর ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা এসব কাজে জড়িত থাকলে দল থেকে বহিষ্কারসহ নির্মোহ কঠোর পদক্ষেপই গণপিটুনির মতো ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মব ছোঁয়াচে অসুখের মতো। এটা বন্ধ করতে না পারলে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যে কোনো পরিস্থিতিতে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা তৈরি হয় এবং এসব ঘটনায় যারা সংখ্যার বিচারে শক্তিশালী হয়, তারা দুর্বলদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখন যে মব হচ্ছে সেগুলো একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং প্রমাণও থাকতে পারে। সেটি আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান হবে। এখন মানুষ যদি নিজেই আইন তুলে নেয়, তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে নৈতিক কোনো ব্যবধান থাকবে না।
ভুয়া মামলার উদ্বেগজনক চিত্র
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশে মিথ্যা মামলা দায়েরের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলার অপব্যবহার হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব মামলার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান না নিয়ে বরং নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ-এর ফুলবাড়ীয়া এলাকার সোলায়মান সেলিম নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, তাকে “মৃত দেখিয়ে” একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ তার ঠিকানায় তদন্তে গেলে তিনি নিজেই ‘ভুয়া মৃত্যু’ ও মামলার কথা জানতে পারেন। নিজের জীবনের নিরাপত্তার আশঙ্কায় তিনি স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
ঘটনাটি ঘটে ৩ আগস্ট, ঢাকার কাজলা এলাকায় গুলির ঘটনা দেখিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী সেলিমের বড় ভাই। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা-কে। অন্যান্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শামীম ওসমান সহ আরও ৪১ জন, এবং অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ১৫০-২০০ আওয়ামী লীগ কর্মী।
এর আগে, ১৭ অক্টোবর খিলগাঁও থানায় জহিরুল ইসলাম খান পান্না (জেড আই খান পান্না)-এর বিরুদ্ধে একটি ভুয়া হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহাদুল ইসলামকে গুলি ও মারধর করে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু মামলার বাদী মো. বাকের সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করেন যে, তিনি পান্নাকে চেনেন না এবং মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে তাও জানেন না। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে পান্না জামিন পান।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে রবি দাস নামে এক মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে। ৬৪ বছর বয়সী এই মুচি ১৮ জুলাই স্ট্রোক করে মারা যান। কিন্তু তার মৃত্যুকে ঘিরে ২৯ নভেম্বর একটি মামলা দায়ের করা হয়—যেখানে অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তাকে হত্যা করেছে। মামলায় ৪৫০ জনেরও বেশি আসামি করা হয়, যার মধ্যে ১৬৮ জনের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, এমনকি শেখ হাসিনার নামও সেই তালিকায় রয়েছে। দুলালের ছেলে বিকাশ দাস বলেন, "আমরা চাই না কেউ আমার বাবার নাম ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করুক।"
এছাড়াও, ২৭ অক্টোবর ফেনীতে দায়ের হওয়া একটি মামলায় ৮৫ জনকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে রয়েছেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। মামলায় ঢাকায় বসবাসরত ব্যবসায়ী ইব্রাহিম পাটোয়ারীকেও আসামি করা হয়, যিনি আদালত থেকে জামিন পান। ইব্রাহিম বলেন, "আমি ওই সময় ফেনীতে ছিলাম না। শেখ হাসিনার পক্ষে কোনো আন্দোলনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।"
মানবাধিকার সংগঠন ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন এবং বিরোধীদের হেয়প্রতিপন্ন করা।
আইনজীবীরা বলছেন, “জুলাই মাসের আন্দোলনের পর দায়ের হওয়া মামলাগুলো এখন দুর্নীতির উৎসে পরিণত হয়েছে। অনেক মামলায় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগেরই কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
মন্তব্য করুন