নিজস্ব প্রতিবেদক
গত মাসে লন্ডন শহরের হোটেল ডোরচেস্টারে অনুষ্ঠিত একটি গোপন বৈঠক ঘিরে বাংলাদেশে নতুন করে রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বৈঠকটি হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর মধ্যে।
এই আলোচনার কিছুদিনের মধ্যেই দেশজুড়ে একের পর এক ‘মব জাস্টিস’ বা দলবদ্ধ প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা সামনে আসতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক এই ধারাবাহিকতার সঙ্গে বৈঠকের ‘সিনক্রোনাইজড টাইমলাইন’ বিশেষভাবে নজরকাড়া।
‘মব জাস্টিস’-এর উদ্বেগজনক উত্থান
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘিরে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে মব-সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলার শিকার হয়েছেন অনেক সাধারণ নাগরিক, এমনকি সরকারের প্রাক্তন কর্মকর্তারাও। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বাড়ি ধ্বংস ও গাজীপুরে সাবেক এক মন্ত্রীর বাসায় হামলার ঘটনা এসব সহিংসতার গভীরতা ও বিস্তারের প্রমাণ দেয়।
বিচারের পরিবর্তে রাস্তায় শাস্তি: নতুন বাস্তবতা
সম্প্রতি ঢাকার শেরেবাংলা নগরে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা-র বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে পুলিশকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেলেও হস্তক্ষেপ করেনি তারা। পরে হুদাকেই গ্রেফতার দেখানো হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত
বিশ্লেষকদের মতে, আইনকে পাশ কাটিয়ে বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। তারা বলছেন, “এই ধরনের সহিংসতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নয়, বরং সাধারণ নাগরিককেও আতঙ্কিত করছে।”
নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা: সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে
২৯ জুন নারায়ণগঞ্জে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে মহানগর বিএনপির সাবেক এক সহসভাপতিকে বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনা ঘটে।
১৩ মে ঢাকা আদালত প্রাঙ্গণে বিচারক মমতাজ বেগমকে ধাওয়া করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আদালত প্রাঙ্গণেই সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক-এর ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা হয়। সিলেটের জাফলংয়ে সরকারের উপদেষ্টাদের গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভও রাজনৈতিক মব সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা।
হা-মীম গ্রুপের এমডি এ কে আজাদের বাড়িতে চড়াও
৩ জুলাই ফরিদপুরে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ-এর বাড়িতে ‘আওয়ামী লীগের গোপন সভা হচ্ছে’ অভিযোগ তুলে মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। ঘটনাস্থল থেকে মিছিল বের করে বিভিন্ন এলাকায় গমন করে তারা। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কাউকে পায়নি বলে জানিয়েছে।
ঝিকরগাছায় প্রতিবন্ধীকে গাছে বেঁধে হত্যা
২ জুলাই যশোরের ঝিকরগাছায় সরকারি ভাতা বন্ধ হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করায় মানসিক প্রতিবন্ধী রফিকুল ইসলামকে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা। নিহতের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। বরং স্থানীয়রা জানান, তিনি কেবলমাত্র তার ভাতা ফিরে পেতে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
কুমিল্লায় একই পরিবারের তিনজনকে হত্যা
মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে কুমিল্লার মুরাদনগরে এক পরিবারের তিনজন সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা। পুলিশ বলছে, এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের ক্ষোভ এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্ররোচক হিসেবে কাজ করেছে।
বিবস্ত্র করে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে মারধর
২৬ জুন রাতে মুরাদনগরের আরেক গ্রামে ফজর আলী নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে উত্তেজিত লোকজন তাকে ও নির্যাতিত নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করে। এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পুলিশ ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা ও বিচারবহির্ভূত প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ড. ইউনূস-এর নেতৃত্বে পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় যে ধরনের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততা এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যে ধারাবাহিক ‘মব জাস্টিস’ ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তা কেবল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নয়—বরং এর পেছনে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প কাজ করছে। তারা মনে করছেন, বিএনপি ও ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু অংশ যেন যৌথভাবে এমন এক সহিংস সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধী শক্তিকে দমন, ভীতি ছড়ানো, এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাকে দুর্বল করে তোলা।
মন্তব্য করুন