নিজস্ব প্রতিবেদক
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বললেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজের কর্মকাণ্ড ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনিয়ম, অর্থপাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে দুদক ৩৯৯টি মামলা করলেও তা কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ—এমনটাই দাবি বিভিন্ন মহলের।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাসহ এক হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হলেও, নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠী এনসিপি এবং শিক্ষার্থীদের ঘিরে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগগুলোতে দুদকের নিরবতা চোখে পড়ছে।
যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগ সংক্রান্ত প্রমাণ চেয়ে আইনজীবীরা একাধিকবার চিঠি পাঠালেও কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে। ল ফার্ম স্টেফেনসন হারউড এলএলপি অভিযোগ করেছে, গত মার্চে অনুরোধ পাঠানোর পরও টিউলিপের বিরুদ্ধে দুদক একটি প্রামাণ্য তথ্যও দিতে পারেনি। এ অবস্থাকে তারা ‘ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন’ বলেও অভিহিত করছেন।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ অভিযোগ করেছেন, দলটির নেত্রী ডা. মাহমুদা মিতুর কাছে এক লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন দুদকের একজন ডিজি ও ডিডি। এই ঘুষ না দিলে ক্লিয়ারেন্স না দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এই অভিযোগের সঙ্গে একটি ভিডিও ক্লিপও যুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে উঠেছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মাধ্যমে দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ। তার একান্ত সচিব মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হলেও এখনো দুদক দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একই সঙ্গে, আসিফের পিতা বিল্লাল হোসেনের ঠিকাদারি লাইসেন্স গ্রহণ, এবং হিযবুত তাহরীর সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে উঠেছে নৈতিক প্রশ্ন।
নোবেল বিজয়ী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রেও একই ধরনের স্বার্থসংঘাতের অভিযোগ উঠেছে। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত অনুমোদন, কর মওকুফ ও শেয়ার হ্রাসের সুবিধা পাওয়ায় সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলা দ্রুত খারিজ হওয়াও জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সাবেক একান্ত সচিব আতিক মোর্শেদের বিরুদ্ধেও উঠেছে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদের ১৫০ কোটি টাকা বেহাত করার অভিযোগ। পাশাপাশি, সেখানে নিজের স্ত্রী ও স্বজনদের চাকরি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তবে এসব অভিযোগের তদন্তে দুদকের কার্যকর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি বিরোধী এই প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ নেতৃত্বের কারণে পক্ষপাতমূলক, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং আস্থাহীন এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য গঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ছিল উচ্চ। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক পক্ষপাত, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রতি নমনীয়তা এবং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণে নিজস্ব বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে। একদিকে হাজারো মামলার কথা বলা হলেও, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বা ঘনিষ্ঠ মহলের দুর্নীতির অভিযোগে নীরবতা ও গড়িমসি—এই দ্বৈত আচরণ জনমনে প্রশ্ন তুলছে। নৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কার্যকর তদন্ত ছাড়া কোনো দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানই মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে না। এখন প্রয়োজন দুদকের দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ ভূমিকা—যা প্রমাণ করবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কোনো দলের বিরুদ্ধে নয়, বরং রাষ্ট্র ও জনতার পক্ষে একটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস।
মন্তব্য করুন