Insight Desk
প্রকাশ : Jul 3, 2025 ইং
অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থার ইতিহাস ও ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন: ১৯৭২ থেকে ২০২৪

এম, কে শাওন

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সূচনা ঘটে স্বাধীনতার পরপরই, ১৯৭২ সালে। শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও নারী কোটাভিত্তিক নিয়োগ চালু হয়। প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ২০ শতাংশ মেধা ও ৮০ শতাংশ জেলা কোটা নির্ধারিত হয়। এই ৮০ শতাংশের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০% এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য ১০% কোটা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা সংস্কার ও রদবদলের মধ্য দিয়ে কোটা ব্যবস্থা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে।

১৯৭৬ সালে প্রথমবার কোটা বণ্টনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। তখন মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ বাড়িয়ে ৪০% করা হয় এবং নারীদের জন্য আলাদা ১০% কোটা সংরক্ষিত হয়। পরে, ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদেরও কোটার আওতায় আনা হয়। ২০০২ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার কোটা পূরণ না হলে মেধা তালিকা থেকে পদ পূরণের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার বাতিল করে এবং নির্দেশ দেয়—কোটা পূরণ না হলে পদ ফাঁকা থাকবে। ২০১১ ও ২০১২ সালে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও কোটার সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কিন্তু মেধার তুলনায় কোটার অংশ বেশি থাকায়, দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমে ওঠে। যদিও মাঝে মাঝে কিছু বিক্ষোভ দেখা গেলেও, ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ এলাকায় প্রথম সংগঠিতভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, যা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে। তবে এটি খুব বড় পরিসরে বিস্তার লাভ করতে পারেনি।

২০১৮ সালে আবারও আন্দোলন শুরু হয়। ফেসবুকে “কোটা সংস্কার চাই” নামের একটি পেইজ এবং “বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ” নামের একটি প্ল্যাটফর্ম এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। আদালতে রিট খারিজ হলেও শাহবাগে বিশাল বিক্ষোভ হয়, এবং সরকার নির্দেশ দেয় যে, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধার ভিত্তিতে পদ পূরণ করা হবে।

২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালের কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে। এর ফলে কোটা পদ্ধতির পুনর্বহালের বাস্তবতা তৈরি হয়। এরপর থেকেই আবারও আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়, যা আপাতদৃষ্টিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণে একটি প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রকৃত রূপ সামনে আসে।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো—২০২৪ সালের এই আন্দোলনের আড়ালে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সক্রিয় ছিল। কোটা আন্দোলনের নামে দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করা ছিল মূল লক্ষ্য। কিছু রাজনৈতিক শক্তি—বিশেষ করে বিএনপি, জামাত-শিবির এবং বিদেশে অবস্থানরত কিছু বিতর্কিত গোষ্ঠী—এই আন্দোলনকে পেছন থেকে উস্কে দিয়েছে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বিভ্রান্ত করে তারা একটি গণআন্দোলনের মোড়কে সরকার পতনের চক্রান্তে লিপ্ত হয়।

সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও তদন্তে উঠে এসেছে, এই আন্দোলনকে বিদেশ থেকে অর্থায়ন করা হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের প্রবাসী চ্যানেল থেকে অর্থনৈতিক লেনদেন ও যোগাযোগের প্রমাণ এখন জনগণের সামনে প্রকাশিত হচ্ছে। একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতাই ‘কোটা সংস্কার’-এর মুখোশ পরে চালানো হয়েছিল—এটি এখন স্পষ্ট।

বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়, তবে ২০২৪ সালের আন্দোলনের মাধ্যমে তা নতুন মাত্রায় পৌঁছায়। মেধা বনাম সংরক্ষণ—এই বিতর্কের আড়ালে যে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র চলেছে, তার মুখোশ এখন উন্মোচিত। দেশের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ও গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে এই বাস্তবতা গভীরভাবে অনুধাবন করা জরুরি।
 ২১ জুলাই ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে ও ৭% কোটা রেখে সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩% নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। 

২৩ জুলাই সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুযায়ী সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে।

২০২৪ সালের ২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করে। এতে হাইকোর্টের দেওয়া সেই রায়টি বাতিল করা হয়, যার মাধ্যমে ২০১৮ সালের কোটা বাতিল সংক্রান্ত সরকারী প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্ট এই রায়ের মাধ্যমে পুনরায় কোটা ও মেধার মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্দেশ দেয়—সরকারি চাকরিতে ৭% সংরক্ষণ রেখে ৯৩% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

এই রায়ের ভিত্তিতে ২৩ জুলাই ২০২৪ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, যা দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কোটা পদ্ধতির বর্তমান কাঠামো নির্ধারণ করে দেয়।

নতুন কোটা কাঠামো

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিচের হারে কোটা সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়:

  • মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫%
  • প্রতিবন্ধী কোটা ১%
  • ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা ১%
  • মোট সংরক্ষণ ৭%
  • মেধা ভিত্তিক নিয়োগ ৯৩%

জেলা কোটা, নারী কোটা এবং অন্যান্য অতিরিক্ত কোটাসমূহ এ প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অর্থাৎ এগুলো বর্তমানে বাতিল বলে গণ্য।

প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, নির্ধারিত কোটায় যদি যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যায়, তাহলে উক্ত পদসমূহ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হবে। ফলে পূর্বের সেই “পদ শূন্য রাখা হবে” নীতির অবসান ঘটে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, কমিশন ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষদের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে এই প্রজ্ঞাপন পাঠানো হয়।

২০২৪ সালের সকল চলমান ও ভবিষ্যৎ নিয়োগে এই নতুন কাঠামো কার্যকর হবে। যার মাধ্যমে ২০১৮ সাল থেকে যে কোটা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ও আইনি জটিলতা চলছিল, তা অবসান ঘটিয়ে এই প্রজ্ঞাপন একটি সুস্পষ্ট, ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত কাঠামো উপস্থাপন করে। ৯৩% মেধা নির্ভর নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়েছে, এবং একইসঙ্গে ৭% সংরক্ষণ রেখে অসুবিধাগ্রস্ত ও বিশেষ শ্রেণিগুলোর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

২৩ জুলাই ২০২৪ সালের প্রজ্ঞাপন শুধু একটি প্রশাসনিক নির্দেশই নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের অবসান ঘটিয়ে ন্যায়ভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার পথে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীলতা, আদালতের নির্দেশনা এবং জনগণের চাহিদার উপর ভিত্তি করে গৃহীত এই প্রজ্ঞাপনটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন।

অথচ মীমাংসিত বিষয় নিয়ে আন্দোলনকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে স্বাধীনতা ও দেশবিরোধী অপশক্তি—তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সরকারকে অস্থিতিশীল করা, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে ফেলতে বাধ্য করা, বৈদেশিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা দুর্বল করা। এবং তারা সফলও হয়।

২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন আরেকটি বড় শিক্ষা দেয়—যে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি যখন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হয়, তখন ক্ষতি হয় দেশের, গণতন্ত্রের, জনগণের এবং সর্বোপরি তরুণ সমাজের। তরুণদের উচিত, নিজেদের দাবি-দাওয়াকে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করা এবং কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতিয়ার না হওয়া। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও জনগণের উচিত এসব ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণভিত্তিক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনসচেতনতা তৈরি করা, যাতে এভাবে আর কোনো অপশক্তি দেশ-জাতি ধ্বংসের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে না পারে।

এম, কে শাওনলেখক, কলামিস্ট

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৈষম্যবিরোধীরাই দেখাল, আন্দোলনে রোহিঙ্গা ও বিহারীদের ভূমিকা

1

মব ভায়োলেন্সে প্যারালাইজড বাংলাদেশের গণমাধ্যম

2

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিশনের সবশেষ তথ্য জানালেন ইউনূস,

3

১৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তির চিন্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

4

ইউনূসের ফাঁদে পা দিল বিএনপি

5

ইউনূসের আশকারায় মবের রাজ হাসনাত, রুখবে কে?

6

তারেক-ইউনূস বৈঠকের পর বিএনপিতে বেড়েছে মব সন্ত্রাস

7

১০ মাসেই অনিয়ম-দুর্নীতির রেকর্ড গড়ল ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরক

8

ইউনূসের জঙ্গি সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল শিক্ষার্থীরা

9

চোট থেকে ফেরার পথে বাংলাদেশের পেস ত্রয়ী

10

এক সময় মানবাধিকারের মুখপাত্র আসদুজ্জামান এখন মবের হোতা?

11

পরিবর্তন হলো মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের শপথ

12

তিন বাহিনীকে নিয়ে জাতির সঙ্গে ইউনুসের প্রেস উইংয়ের মিথ্যাচ

13

ড. ইউনূস সম্পর্কে বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফার সতর্কবার্তা

14

মব ভায়োলেন্সে প্যারালাইজড দেশের গণমাধ্যম

15

ইউনূসের সরকারের অধীনে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনায়

16

জুলাই: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের পুনরুত্থানের মাস

17

মুদি দোকানে এক মাসের বিদ্যুৎ বিল সাড়ে ১৩ লাখ টাকা!

18

জঙ্গি নিয়ে ইউনূসের পুলিশবাহিনীর মিথ্যাচার ফাঁস করল মালয়েশিয়া

19

সেবা নিতে হয় ঘুষ দিয়ে, মত প্রকাশেও শ্বাসরোধ

20