নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যু। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। গত ৩০ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র বলছে, এই ফোনালাপে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন মিশনের সবশেষ অবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে ইউনূস ও রুবিওর। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, প্রায় ১৫ মিনিটব্যাপী এ আলোচনা হয়। তবে অন্যান্য ফোনালাপের বিস্তারিত জানালেও এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।
বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে জাতিসংঘের ঘোষিত তিন বছর মেয়াদী প্রকল্প ব্যালট। এর লক্ষ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা হলেও, বিশ্লেষকদের মতে, প্রকল্পটি বাস্তবিক অর্থে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার পাঁয়তারা।
বিশ্লেষক ও কূটনৈতিক সূত্রের দাবি, এই অনিশ্চয়তা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফসল নয়, বরং একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই অধ্যাপক ইউনূসের সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। আর আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তাবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না।
২০১৮ সালে মিয়ানমারে অং সান সু চির সরকার চীনের সঙ্গে কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে চুক্তি করে। এই চুক্তির পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র রাখাইন রাজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পনায় নামে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। পরবর্তী সময় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞ, তাদের বাংলাদেশে স্থানান্তর এবং মানবিক করিডোর স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল সেই মার্কিন কৌশলের অংশ। আর এ জন্য মার্কিনিদের দরকার চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণও। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূস হচ্ছেন বাংলাদেশের ‘‘অং সান সুচি’’। যে সুচিকে মার্কিনিরা ক্ষমতায় এনেছিল চীনকে ঠেকাতে, কিন্তু পরে ব্যর্থ হলে তাকে সরিয়ে কারাবন্দি করে। এবার সেই একই মডেলে ইউনূসকে বসানো হয়েছে ক্ষমতায়। যদি মার্কিন স্বার্থ পূরণ না হয়, তাহলে ইউনূনের ভবিষ্যৎও হবে সুচির মতো।
সূত্র বলছে, ড. ইউনূসকে জাতিসংঘ মহাসচিব বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। বিনিময়ে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে এক উচ্চপর্যায়ের প্রক্সি যুদ্ধে, যার মূল লক্ষ্য—বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি, মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের সহযোগিতা এবং চীনের ‘‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’’ পরিকল্পনা ব্যাহত করা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের দখল, রোহিঙ্গা করিডোর এবং কৌশলগত বন্দর ব্যবহার ঘিরে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম ক্ষেত্র। এই অবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়া কিংবা রাষ্ট্রগঠনে অর্থব্যয়ে তাদের আগ্রহ “নিতান্তই কম”।’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর মধ্যকার সাম্প্রতিক ফোনালাপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উভয় দেশের পক্ষ থেকে ওই ফোনালাপের যে বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে ওয়াশিংটনের কাছে এখন ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব বাণিজ্য ও আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষেত্রে।’
কুগেলম্যান লিখেছেন, দুই নেতা অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (ইন্দো-প্যাসিফিক) নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে অংশীদারত্বের বিষয়ে আলোচনা করেন। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তার অর্থ হলো চীনের প্রভাব মোকাবিলা। কিন্তু এ দুটি লক্ষ্যই বাংলাদেশের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে মনে করেন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ।
কুগেলম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি না হলে বাংলাদেশকে ৩৭ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়তে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতে অটুট রয়েছে, এতে কোনো বড় শক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান না নেওয়ার কৌশল অনুসরণ করা হয়।
কুগেলম্যান বলেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার পর যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। বাইডেন প্রশাসনের শেষ দিকে শেখ হাসিনার দেশ থেকে পলায়নের পর গণতন্ত্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে উন্নয়ন সহায়তা ও কারিগরি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ফোনালাপের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টা উভয়েই যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন।’
সেনাবাহিনী পুলিশ, বিমানবাহিনীর পর এবার নৌবাহিনীর ধ্বংসের পাঁয়তারা
গত জুলাই আন্দোলনে হাজারের বেশি মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ইউনূসের মদদপুষ্ট আন্দোলনকারীরা। গত মে মাসে পুলিশের হাতে ‘মারণাস্ত্র’ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া মারণাস্ত্র ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যখন পুলিশ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত থাকবে না, তখন সরকারের এই সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হতে পারে। অপরাধীদের হাতে থাকা আধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে শুধু শটগান বা খালি হাতে থাকা পুলিশ তাদের মোকাবিলা করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্ত পুলিশের মনোবল বাড়ানোর পরিবর্তে আরও দুর্বল করে তুলছে। পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তবে বিক্ষোভ বা আন্দোলন দমনে যেন মারণাস্ত্র ব্যবহার করা না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন তারা।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করবে। সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার কৌশল থেকে থাকলে ভালো। চরম শক্তি প্রয়োগ করার বন্দোবস্ত যদি না থাকে, তাহলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা খুব মুশকিল হয়ে যাবে। পুলিশকে তো মোকাবিলা করতে হয় সংঘটিত অপরাধীদের, উগ্রবাদীদের, চরমপন্থিদের। সাধারণ জনশৃঙ্খলার বিষয় যখন আসে তখন শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এখন যদি অস্ত্র না থাকে তাহলে কী দিয়ে সে মোকাবিলা করবে!’
এরইমধ্যে সেনাবাহিনীকেও ক্যান্টমেন্ট থেকে নামানো হয়েছে রাস্তায়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মব ও হামলার শিকার হচ্ছেন তারা। এতে এই বাহিনীকে বেসামরিক নাগরিকদের কাছে ছোট করছে ইউনূস সরকার। যেখানে তাদের দেশকে বাইরের হামলা থেকে রক্ষা করার কথা। সেখানে তারা এখন বিভিন্ন অলিতে গলিতে গিয়ে নানা ধরনের অপরাধ ঠেকাতে বাধ্য হচ্ছে।
গত ৫ আগস্টের পর সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বিমানবন্দরকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যায়। তখন থেকেই বিমান বাহিনী বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরমাধ্যমে বিমানবাহিনীকেও তাদের মূল কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
এবার চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে সাইফ পাওয়ার টেক। সোমবার থেকে টার্মিনাল পরিচালনা করবে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এভাবে বাহিনীগুলোকে নিজেদের কাজে যুক্ত না রেখে নিজেদের স্বার্থে নানা ধরনের কাজ করাচ্ছে সরকার। এর ফলে তাদের মূল কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর পাশাপাশি দেশের সার্বিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে রয়েছে।
মন্তব্য করুন