নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত নাম হাসনাত আব্দুল্লাহ আবারও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। মব ভায়োলেন্সের হুমকি, সাংবাদিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে উদ্বেগ বাড়ছে রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে।
গত ১৮ ডিসেম্বর একটি বিস্ময়কর ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। সিটি গ্রুপের এমডির সঙ্গে দেখা করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলীয় মূখ্য সংগঠক ও জুলাই আন্দোলনের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ একটি তালিকা পেশ করেন, যেখানে ১০ জন কর্মীর নাম ছিল। দাবি—তাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে। অভিযোগ উঠেছে, এ বিষয়ে তিনি মব ভায়োলেন্স-এর হুমকিও দেন। ওইদিনই তালিকাভুক্ত পদত্যাগ করতে বলা হয় এবং হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বরখাস্তের নোটিশ পাঠানো হয়।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই, গত ৬ জুলাই রাজশাহী নগরীর রেলগেট থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এনসিপির একটি পদযাত্রায় অংশ নেন হাসনাত। সেখানকার সমাবেশে তিনি সরাসরি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
তার ভাষায়, খুনি হাসিনার পক্ষে বসুন্ধরার মিডিয়া যে ভূমিকা পালন করেছে, তা আমরা ভুলে যাইনি। বসুন্ধরার সাংবাদিকরা আবারও অপরাধের বৈধতা দিতে মাঠে নেমেছেন। তারা আরেকটি এক-এগারোর ষড়যন্ত্র করছেন, যা জনগণ কখনো বরদাশত করবে না।”
এমন বক্তব্য শুধু গণমাধ্যম নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহর আরেকটি আলোচিত পরিচয়—‘মবের রাজা’। বিভিন্ন সময়ে তিনি জনরোষ এবং সহিংস উসকানির পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, মব এবং জনরোষ এক নয়। যারা এই বাংলাদেশকে ধ্বংস করেছে, তাদের বিচার যখন সরকার করতে পারেনি, তখন জনগণের রোষই বিচার করেছে। আমি এটাকে মব বলি না।”
এ বক্তব্য মব জাস্টিফিকেশনের এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এর আগে, মার্চ মাসে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে চেষ্টাও করেন হাসনাত। এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি দাবি করেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের পরিকল্পনা চলছে। এই বক্তব্যে তার নিজের দল এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলম প্রকাশ্যে দ্বিমত পোষণ করলে, হাসনাতের সেনাবিরোধী প্রচারণা কার্যত ব্যর্থ হয়।
মব জাস্টিস’-এর উদ্বেগজনক উত্থান
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘিরে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে মব-সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলার শিকার হয়েছেন অনেক সাধারণ নাগরিক, এমনকি সরকারের প্রাক্তন কর্মকর্তারাও। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বাড়ি ধ্বংস ও গাজীপুরে সাবেক এক মন্ত্রীর বাসায় হামলার ঘটনা এসব সহিংসতার গভীরতা ও বিস্তারের প্রমাণ দেয়।
গবেষণা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হন।
বিচারের পরিবর্তে রাস্তায় শাস্তি: নতুন বাস্তবতা
সম্প্রতি ঢাকার শেরেবাংলা নগরে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা-র বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে পুলিশকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেলেও হস্তক্ষেপ করেনি তারা। পরে হুদাকেই গ্রেফতার দেখানো হয়।
গবেষণা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হন।
বিশ্লেষকদের মতে, আইনকে পাশ কাটিয়ে বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। তারা বলছেন, এই ধরনের সহিংসতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নয়, বরং সাধারণ নাগরিককেও আতঙ্কিত করছে।”
নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা: সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে
২৯ জুন নারায়ণগঞ্জে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে মহানগর বিএনপির সাবেক এক সহসভাপতিকে বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনা ঘটে।
১৩ মে ঢাকা আদালত প্রাঙ্গণে বিচারক মমতাজ বেগমকে ধাওয়া করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আদালত প্রাঙ্গণেই সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক-এর ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা হয়। সিলেটের জাফলংয়ে সরকারের উপদেষ্টাদের গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভও রাজনৈতিক মব সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা।
হা-মীম গ্রুপের এমডি এ কে আজাদের বাড়িতে চড়াও
৩ জুলাই ফরিদপুরে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ-এর বাড়িতে ‘আওয়ামী লীগের গোপন সভা হচ্ছে’ অভিযোগ তুলে মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। ঘটনাস্থল থেকে মিছিল বের করে বিভিন্ন এলাকায় গমন করে তারা। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কাউকে পায়নি বলে জানিয়েছে।
ঝিকরগাছায় প্রতিবন্ধীকে গাছে বেঁধে হত্যা
২ জুলাই যশোরের ঝিকরগাছায় সরকারি ভাতা বন্ধ হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করায় মানসিক প্রতিবন্ধী রফিকুল ইসলামকে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা। নিহতের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। বরং স্থানীয়রা জানান, তিনি কেবলমাত্র তার ভাতা ফিরে পেতে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
কুমিল্লায় একই পরিবারের তিনজনকে হত্যা
মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে কুমিল্লার মুরাদনগরে এক পরিবারের তিনজন সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা। পুলিশ বলছে, এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের ক্ষোভ এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্ররোচক হিসেবে কাজ করেছে।
বিবস্ত্র করে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে মারধর
২৬ জুন রাতে মুরাদনগরের আরেক গ্রামে ফজর আলী নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে উত্তেজিত লোকজন তাকে ও নির্যাতিত নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করে। এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পুলিশ ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশকারা পেয়ে যারা মব রাজনীতিকে বৈধতা দিতে চাইছেন, তারা গণতন্ত্র ও সামাজিক স্থিতির জন্য চরম হুমকি।
মন্তব্য করুন