নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাইয়ের আন্দোলনে রোহিঙ্গা ও বিহারিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বলে নিশ্চিত করেছে বৈষম্যবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন ও আন্দোলন পর্যবেক্ষণকারী বিশ্লেষকরা। আন্দোলনে সহিংস অংশগ্রহণকারী সবচেয়ে সংগঠিত ও আগ্রাসী অংশ হিসেবে উঠে এসেছে জেনেভা ক্যাম্পের কিছু বিহারির নাম। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা যুবকদের পক্ষ থেকেও অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সরবরাহের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি উঠেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামও কিছুদিন আগে জেনেভা ক্যাম্পে জনসংযোগ করেন, যা বিহারিদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগের ইঙ্গিত দেয়। আন্দোলনের সহিংস অংশে রনি নামে এক বিহারির ‘শহীদ’ হওয়ার বিষয়টি সামনে আসলেও এখনো তার স্বীকৃতি মেলেনি। অন্যদিকে রোহিঙ্গা অংশগ্রহণকারী নূর মোস্তফা ইতোমধ্যে ‘শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এই সম্পৃক্ততা শুধু রাজনৈতিক নয়, তা নিরাপত্তাজনিত দিক থেকেও উদ্বেগজনক। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং সরবরাহ দেওয়া হয়েছে, যা আগুন দেওয়া, পুলিশের ওপর হামলা ও সহিংসতা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়া, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের অবস্থান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তগুলোও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দেন, মিয়ানমার প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে তিনি নিজেই বলেন, নতুন করে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৩ হাজারে। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে সরকারের অবস্থান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়।
তার চেয়েও বিতর্কিত হয়ে ওঠে মানবিক করিডোর বিষয়টি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির আশঙ্কার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের অনুরোধে করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার বা আরাকান আর্মি কেউই করিডোর চায়নি। ফলে এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে সেনাবাহিনীর একটি অংশ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়।
সাবেক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতা বলে দেয়, আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মানবিক করিডোরগুলোর অনেকগুলো ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে। এই প্রেক্ষাপটে, রোহিঙ্গা ও বিহারিদের আন্দোলনে সম্পৃক্ততা, রাখাইনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং সরকারের দ্ব্যর্থতাপূর্ণ অবস্থান সব মিলে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করছে।
এদিকে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, বিহারিরা যেন একাত্তরের প্রতিশোধ নিচ্ছে। কারণ, এই উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, এই সম্প্রদায়ের একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। সেই সময় থেকেই তাদের অনেককে অটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এবং দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার অভিযোগ করে আসছে তারা।
এই সংবেদনশীল ইতিহাসের পটভূমিতেই অনেকেই মনে করছেন, জুলাই আন্দোলনে বিহারিদের তৎপরতা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং ঐতিহাসিক আক্রোশের বহিঃপ্রকাশও হতে পারে। আন্দোলনে নিহত রনি নামের এক বিহারিকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি উঠেছে। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা অংশগ্রহণকারী নূর মোস্তফা ইতোমধ্যে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
জনগণ এখন প্রশ্ন তুলছে, আন্দোলনে রোহিঙ্গা ও বিহারিদের এই ভূমিকা কীভাবে এলো? কে বা কারা তাদের সমন্বয় করছে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, একাত্তরে যারা এই ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তারা কি আবার ইতিহাসের ষড়যন্ত্রে অস্ত্র ধরেছে? বিহারিদের একাংশ এবং রোহিঙ্গা মিলিশিয়াদের সক্রিয়তা যদি শুধু একটি আন্দোলন পর্যন্ত সীমিত না থাকে, তবে এ এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের পূর্বাভাস। এমন জোট যদি গড়ে ওঠে—রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব, পুরনো ক্ষোভ, অস্ত্রচর্চা আর আন্তর্জাতিক সহানুভূতির মুখোশে—তবে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হতে পারে।
মন্তব্য করুন