Insight Desk
প্রকাশ : Jun 25, 2025 ইং
অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশে চলছে চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, ডাকাতি ও মবের রাজত্ব

বাংলাদেশে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা এবং জনজীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসছে সাম্প্রতিক তথ্য ও ঘটনাপ্রবাহে। একদিকে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা, অন্যদিকে প্রকাশ্য ডাকাতি ও মব—সব মিলিয়ে দেশে ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন, নারীবিষয়ক সংগঠন ও নাগরিক সমাজ বিষয়টিকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে এবং এর পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছে।

নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জনই শিশু। তাদের মধ্যে আট বছরের শিশু আছিয়ার করুণ মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। গত ৬ মার্চ মাগুরায় আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় সে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর ১৩ মার্চ ঢাকায় মারা যায় আছিয়া।

একের পর এক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড: মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র- আসক এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী।  এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুইটি ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন।

ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছেন। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুই জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে। এছাড়া মার্চ মাসে ৯টি ধর্ষণের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। এরমধ্যে মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ‘ধর্ষণের শিকার' শিশু; চিপস কিনে দিয়ে প্রতিবন্ধী তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ; খাবার ও বেলুনের লোভ দেখিয়ে দুই শিশুকে ধর্ষণ; ফরিদপুরে সাইকেলে ঘোরানোর কথা বলে শিশুকে ধর্ষণ; টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে শিশুকে ধর্ষণ, সালিসে দেড় লাখ টাকা জরিমানা; গাজীপুরে ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণ; সীতাকুণ্ডে সৈকতে বন্ধুকে বেঁধে রেখে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ; নরসিংদীতে ৩ দিন আটকে রেখে গর্ভবতী নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত জন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে একজনকে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ২০২৪ সালে ২১ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

আসকের পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালের শেষের চার মাস যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন অন্তত ১৬৬ জন নারী। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুই জন ও খুন হয়েছে তিন জন নারী। এ ছাড়া ২০২৪ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ৫২৩ জন নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১৭৪ জন।

এমএসএফ এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ১৫১ জন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮১ জন নারী ও ৩৩১ জন শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে সাত জনকে, ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৮ জন ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন।

মহিলা পরিষদের মতে, এই ঘটনারা নারীদের স্বাভাবিক জীবনযাপন, শিক্ষাগমন ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে চরম বাধা সৃষ্টি করছে। তারা দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়।

প্রকাশ্যে ছিনতাই-ডাকাতি: ১৮ মে রাজধানীর মগবাজারে চাপাতি হাতে প্রকাশ্যে এক তরুণের ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। আক্রান্ত তরুণ আবদুল্লাহ কুমিল্লার বাসিন্দা। এ ধরনের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। বনশ্রী এলাকায় সোনার ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি ও কুপিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাইয়ের ঘটনাও রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

ডাকাতি ও দস্যুতার পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক : পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০২৫-এ ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে ২৪২টি – আগের বছরের তুলনায় ৬৯% বেশি। ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ২৩০টি – ৭০% বেশি। আগস্ট ২০২৪ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ১,১৪৫টি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০% বেশি।

রাজনৈতিক দায় এবং সরকারের নিষ্ক্রিয়তা : নাগরিক সমাজ এবং অধিকারকর্মীদের মতে, এই নিরাপত্তাহীনতার জন্য দেশের অন্তর্বর্তী সরকার দায় এড়াতে পারে না। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের দুর্বলতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব—সব মিলিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার আজ হুমকির মুখে।

ইউনূসের মদদে ছাত্রনেতা ও এনসিপির চাঁদাবাজি রুখবে কে? : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রত্যক্ষ মদদে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ও এর রাজনৈতিক মিত্র সংগঠন ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ পরিণত হয়েছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের গোপন সিন্ডিকেটে।
‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে’ স্লোগান তুলে যে সংগঠন শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকের অধিকার রক্ষার দাবিতে—তা আজ নিজেই রূপ নিয়েছে নির্যাতন, ঘুষ বাণিজ্য, তদবির সিন্ডিকেট এবং দখলদার মানসিকতার দুর্গে। রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বল, এমনকি সরকারি দপ্তরেও এই ছাত্র সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে টর্চার সেল চালানো, অর্থ আদায়, চাকরি বিক্রির চেষ্টা এবং ভুয়া পরিচয়ে প্রভাব বিস্তারের গুরুতর অভিযোগ।

এতসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে ছায়ার মতো কাজ করছে একটি বড়সড় পৃষ্ঠপোষকতা। অভিযোগ রয়েছে, ইউনূসপন্থী উপদেষ্টারা এবং ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মহলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে সংগঠনটির কিছু নেতা–কর্মী এখন ‘দুর্নীতি ও দখলের লাইসেন্সধারী’ হয়ে উঠেছে।

গত ১২ জুন, গাইবান্ধায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নামে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের চাঁদাবাজির প্রতিবাদে শহরের ডিবি রোডে তারা মানববন্ধন করে। ৮ মে রংপুরে বৈষম্যবিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন সংগঠনের জেলা কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান লিওন। তিনি অভিযোগ করেন, সংগঠনের জেলা আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব চাঁদাবাজি, মামলার তদবির ও সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতিতে জড়িত। 

টঙ্গীতে এক কারখানায় বিশৃঙ্খলার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা গ্রেফতার হন। একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। 

ঢাকার মিরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অফিসে ব্যবসায়ীদের ধরে এনে মারধর, ব্ল্যাঙ্ক চেকে স্বাক্ষর ও স্টাম্পে সই নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে নেতৃত্ব দেন সংগঠনের ঢাকা মহানগর যুগ্ম আহ্বায়ক সাদমান সানজিদ ও রিফাতুল হক শাওন। তাদের সঙ্গে শাহ আলী থানার সদস্যসচিব পারভেজসহ আরও অনেকে জড়িত।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, অভিযুক্তরা নিজেদের এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের ছোট ভাই পরিচয় দিয়ে দফতরে প্রভাব বিস্তার করে। তাদের ছবি ব্যবহার করে মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের উপর হামলা, লুটপাট এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও পাওয়া গেছে। 

এই সব ঘটনায় প্রমাণ হয়, “বৈষম্যের বিরুদ্ধে” বলা আন্দোলন আসলে ক্ষমতা, প্রভাব, ও পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয়ে এক ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দখলদারিত্বে পরিণত হয়েছে।এতে করে সত্যিকারের আন্দোলন, সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনগণের ওপর প্রভাব ফেলছে ভয়াবহভাবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, তথাকথিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলা সংগঠনটি আদতে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও ক্ষমতার আশ্রয়ে একটি দুর্নীতিবাজ চক্রে পরিণত হয়েছে। সাধারণ ছাত্র ও নাগরিকদের আন্দোলনের ব্যানারে তারা গড়ে তুলেছে অর্থনৈতিক দখলদারিত্ব, ভয়ভীতির সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক জবরদখল। প্রশ্ন উঠছে—দলের পেছনে থাকা ড. ইউনূসের মতো মূল পৃষ্ঠপোষকরা এই অপকর্মের দায় এড়াতে পারেন?

বিভিন্ন জেলায় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ: দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, জবরদস্তি এবং সন্ত্রাসমূলক তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে একের পর এক মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে প্রবাসী এক ব্যবসায়ীকে মারধরের অভিযোগে সাদিপুর ইউনিয়ন বিএনপির ৪ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি শাহজাহান ভূঁইয়াকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার কাছ থেকে একটি বন্দুক ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রবাসীর ব্যবসা দখলে নিতে চাঁদা দাবি করে ব্যর্থ হয়ে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা করেন।

ফতুল্লায়, থানার বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরীকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের চেষ্টা চালানোর অভিযোগ রয়েছে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ফয়সল আহমদ সাগরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় বিএনপির সভাপতি স ম আফসার আলী ও সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান টুটুলসহ অজ্ঞাতনামা ৩০–৫০ জনের বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির পর পুকুর থেকে মাছ উঠিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পিবিআই।

কুড়িগ্রামের রৌমারীতে যাত্রাপুর পশুর হাটে ইজারাবিহীনভাবে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে বিএনপির স্থানীয় আহ্বায়ক মাহবুব রহমান ও এক সহযোগীকে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়। পরে তারা জামিনে মুক্তি পান।

মব উস্কে দেশ ধ্বংসের নীলনকশা করেছে ইউনূস গং:  প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে মবের মাধ্যমে দেশ ধ্বংসের নীলনকশা রচিত হচ্ছে। ক্ষমতার শূন্যতাকে সুযোগ করে নিয়ে এসব মব সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে দেশের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই নয়, বরং জাতির উন্নয়ন এবং শান্তি বিনষ্ট করে দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা। এই নীলনকশার ফলে সাধারণ মানুষ ও দেশের স্থিতিশীলতা গভীর হুমকির মুখে পড়েছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সারা দেশে অসংখ্য মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া হয়েছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মবসন্ত্রাসীরা বিনা বাধায়ই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবীদের৷ লুটপাট, দখলের ঘটনা ঘটেছে অনেক৷ মব সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহতও হয়েছেন অনেক।

২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম নূরুল হুদা। তার বাসা ঢাকার উত্তরায়। গত রোববার বিকেলে তার বাসার সামনে একটি মব জড়ো হয়। এরপর একদল লোক তাঁর বাসায় ঢুকে তাঁকে বাইরে এনে প্রকাশ্যে গলায় জুতার মালা পরায় ও জুতাপেটা করে। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, নূরুল হুদা সাদা টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরে আছেন এবং তাঁকে ঘিরে একদল লোক জুতার মালা পরিয়ে রেখেছে। একজন ব্যক্তি তাঁকে জুতা দিয়ে আঘাত করছেন। পুলিশ খুব কাছেই দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কেউ কেউ তাঁকে ডিম ছুড়ে মারছিল এবং নানা কায়দায় হেনস্তা করছিল। দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে চলে এ মব সন্ত্রাস।

সাবেক সিইসি-কে মব হেনস্তার ঘটনার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের দায়সারা বিবৃতি: বিবৃতিতে বলা হয়- সরকার আবারও অনুরোধ জানাচ্ছে, কেউ যেন আইন নিজের হাতে না তোলে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতেই হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর আক্রমণ বেআইনি, আইনের শাসনের পরিপন্থী ও একটি ফৌজদারি অপরাধ। যারা মব তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএসএস এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত মব সন্ত্রাসের ২০২টি ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত ও ২০২ জন আহত হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৮৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন মব হিংসায়।

মব ভায়োলেন্সের পরিসর এখন পারিবারিক ক্ষেত্রেও পৌঁছেছে। রোববার হিরো আলম রামপুরায় তার তৃতীয় স্ত্রীর বিরুদ্ধে হট্টগোল শুরু করেন। এরপর স্থানীয়রা "রিয়ামনি" ও এক ব্যক্তি ম্যাক্স অভি রিয়াজকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পরে তারা জামিন পান। একই দিনে লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পরেশ চন্দ্র শীল (৬৯) ও তার ছেলে বিষ্ণুকে মব প্রহার করে সেলুনে আটকে রাখে। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

অভিনেতা সিদ্দিক, হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফা, শিক্ষক মিল্লাত হোসেন—এরা সবাই মব সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। এমনকি পুলিশের নিজস্ব সদস্যরাও নিরাপদ নন। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার ৭০টি ছিল বড় ধরনের

আদালত চত্বরে পর্যন্ত চলছে এ ধরণের হেনস্তা। সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আইনজীবীরাও আক্রান্ত হয়েছেন আদালত প্রাঙ্গণে। গত ২৩ মে মানিকগঞ্জ আদালতে সাবেক সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের ওপর ডিম নিক্ষেপ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। গত ২৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আদালতের এজলাস থেকে বের হওয়ার সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মব উস্কে মারধরের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালতে তোলার সময় 'সংক্ষুব্ধ বিএনপন্থী আইনজীবীরা' স্লোগান দেন এবং শুনানি শেষে এজলাস থেকে বের হওয়ার সময় তাকে চড়-থাপ্পড় দেন।

সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “নূরুল হুদা তো সাংবিধানিক পদে ছিলেন। তাকে মব দিয়ে বিচার করা যায় না। তিনি যদি অপরাধী হন, তবে আদালতেই বিচার হোক। কিন্তু পুলিশ তখন ব্যবস্থা নেয়নি—এটি বড় প্রশ্ন।”

মঙ্গলবার (২৪ জুন) সকাল রাজধানীর হাতিরপুলে এক সংবাদ সম্মেলনে গণসংহতি আন্দোলনের মুখপাত্র জোনায়েদ সাকি বলেন,  মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয়, শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানো যাবে না বলে জানিয়েছেন মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয়, শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানো যাবে না।

মব ভায়োলেন্সে প্যারালাইজড দেশের গণমাধ্যম : বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এক গভীর সংকটে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের চাপ, মব ভায়োলেন্স এবং সাংবাদিকদের ওপর অনবরত হুমকির কারণে দেশের সংবাদমাধ্যম কার্যত প্যারালাইজড হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল থেকে সাংবাদিক ছাঁটাই, এক্রিডিটেশন বাতিল, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে মিডিয়া ব্যবহার—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতার ওপর এক ঘনীভূত কালো মেঘ জমেছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সময় টিভি থেকে চাকরিচ্যুত হন প্রধান বার্তা সম্পাদক মুজতবা দানিশ, চিফ আউটপুট এডিটর লোপা আহমেদ ও অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর খান মুহাম্মদ রুমেল। আরেক দফা চাপ আসে ১৮ ডিসেম্বর, যখন রাজনৈতিক নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সিটি গ্রুপের এমডির সঙ্গে দেখা করে ১০ জনের নাম সম্বলিত একটি তালিকা দেন এবং তাদের চাকরিচ্যুতির জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ মব ভায়োলেন্সের হুমকি দেন।  একই দিন তালিকাভুক্ত পাঁচজনকে পদত্যাগ করতে বলার পর হোয়াটসঅ্যাপে তাদের বরখাস্তের নোটিশ পাঠানো হয়।

গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়নের আরেক দৃষ্টান্ত দেখা যায় ২৯ এপ্রিল, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব ঘিরে। পরদিন দীপ্ত টিভি তাদের প্রধান খবরের বুলেটিন বন্ধ রাখে এবং সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট মিজানুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করে। একই ঘটনার জেরে এটিএন বাংলা বরখাস্ত করে ফজলে রাব্বীকে এবং চ্যানেল আই অব্যাহতি দেয় রিপোর্টার রফিকুল বাসারকে।

একের পর এক এসব ঘটনায় প্রতীয়মান হচ্ছে, সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ১৬৭ জন সাংবাদিকের এক্রিডিটেশন বাতিল করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা এইচআরডব্লিউ জানায়, জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে ১৪০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয় এবং ১৫০ জনের অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে ১৯ জনের বিরুদ্ধে।

এ পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে প্রচারেও ব্যবহার হচ্ছে মিডিয়া। ঈদুল আজহার দিনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে এক ব্যক্তির “স্যার, আপনাকে পাঁচ বছর চাই” বক্তব্য ছিল সুপরিকল্পিত। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সাজানো নাটক। ভিডিওটি শফিকুল ইসলাম নামের এক কর্মকর্তা পোস্ট করার পর গণমাধ্যমে তা জোরপূর্বক ছড়ানো হয়।

এই দৃশ্যমান কৌশল মূলত জনসমর্থন তৈরি ও আস্থা পুনরুদ্ধারে এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। ধর্মীয় উৎসব ও ঈদগাহের মতো পবিত্র মঞ্চ ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের এই প্রচেষ্টা সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে।

সাংবাদিকরা আজ স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতে ভয় পান। চাকরি হারানো, মামলা, তদন্ত, হেনস্তা কিংবা লাইসেন্স বাতিলের ভয় তাদের বাকরুদ্ধ করে রাখছে। এর ফলাফল শুধু মিডিয়ার নয়—গণতন্ত্রেরও।

বাংলাদেশে গণমাধ্যম আজ আর কেবল সত্য তুলে ধরার মাধ্যম নয়—তা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক চাপ, ভয়ের সংস্কৃতি ও নিয়ন্ত্রণের শিকার এক পরনির্ভর প্ল্যাটফর্ম। যেখানে প্রশ্ন করার অপরাধে সাংবাদিককে চাকরি হারাতে হয়, সেখানে স্বাধীনতা কেবল এক অলীক ধারণা।

ইউনূসের শাসনামলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিপর্যস্ত:  ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর বাংলাদেশ এক নতুন, কিন্তু বিপজ্জনক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে—শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, দেশের সাংস্কৃতিক নিদর্শন, আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এক সংগঠিত হামলা চলছে। এসব হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এগুলো আদর্শিকভাবে চালিত। মব দিয়ে এসব হামলা করানো হচ্ছে।  এ নিয়ে ইউনূস প্রশাসনের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

“নিরপেক্ষতা” ও “সংস্কার”-এর অঙ্গীকার দিয়ে শুরু হওয়া এ সরকার এখন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি এবং অতিরক্ষণশীল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জন্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বহুত্ববাদী মূলনীতির বিরুদ্ধে এক আদর্শিক যুদ্ধের ঢাল।

সুফি মাজারের ওপর একের পর এক আক্রমণ : বাংলার আধ্যাত্মিক প্রাণসত্তা—সুফি মাজারগুলো—যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক ছিল, সেগুলো এখন জনসমক্ষে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে।  নর্থ ইস্ট নিউজের  তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০৫টিরও বেশি সুফি মাজার হামলার শিকার হয়েছে।

শিল্প, সিনেমা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন : বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোও ছাড় পায়নি। আগস্ট ২০২৪ থেকে শুরু করে সিনেমা হল, ভাস্কর্য, আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি নানা জায়গায় হামলা হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির সমর্থকরা এসব স্থাপনায় আগুন লাগিয়েছে বা ভাঙচুর করেছে। দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, জাতীয় চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য , শশী লজের ভেনাস মূর্তি অপসারণ বা বিকৃত করা হয়েছে।

সমাজসচেতন চলচ্চিত্র প্রদর্শনকারী সিনেমা হলগুলোও হামলা বা হুমকির মুখে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ এক নতুন ধরণের সেন্সরশিপ—ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া, শিল্পীদের কণ্ঠরোধ করা।

ধানমন্ডি ৩২-এর করুণ পরিণতি:  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি-বিজড়িত ঐতিহাসিক বাসভবন ধানমন্ডি ৩২-এর ওপর হামলা জাতিকে সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত দুইবার হামলার পর, অবশেষে এটি জুলাই আন্দোলন ও এনসিপি কর্মীদের নেতৃত্বে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পুলিশ ঘটনার সময় উপস্থিত থাকলেও কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি।

প্রেস এক্সপ্রেস এবং দ্য ওয়্যার-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই হামলা ছিল পরিকল্পিত। প্রবাসী ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য সামাজিক মাধ্যমে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে একে “আওয়ামী শাসনের প্রতীকের অপসারণ” হিসেবে তুলে ধরেন। অথচ ইউনূস প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল—নির্বাক।

না কোনো গ্রেপ্তার, না তদন্ত, না কোনো রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা। যেন বার্তা একটাই—বাংলাদেশের ইতিহাস এখন দর কষাকষির বস্তু, জনরোষের বলি।

রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারও রক্ষা পাচ্ছে না: ২০২৫ সালের ১২ জুন সিরাজগঞ্জে অবস্থিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বাড়ি, কাচারি বাড়ি জাদুঘর, একদল উগ্রবাদী দ্বারা ভাঙচুরের শিকার হয়। নোবেল বিজয়ী এই কবির অবস্থান ধর্ম-বর্ণ-সীমার ঊর্ধ্বে হলেও, তার ওপর অভিযোগ এসেছে "হিন্দু সাংস্কৃতিক আধিপত্য" ছড়ানোর। ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, জাদুঘরটি বন্ধ করে "প্রাথমিক তদন্ত" শুরু করা হয়েছে—যেটা কার্যত এক অর্থহীন প্রক্রিয়া।

মব উস্কে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের চেষ্টায় ইউনূস গং: অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের চেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে অস্থিরতা, যেখানে শিক্ষকরা হচ্ছেন নির্যাতনের শিকার এবং জোর করে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন শিক্ষক হয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে শিক্ষকরাই সবচেয়ে অবহেলিত হয়ে পড়েছেন। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিভিন্ন অজুহাতে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করছে, যা শিক্ষক সমাজের আত্মমর্যাদায় বড় ধাক্কা দিয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, প্রায় দুই হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার শিক্ষক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রায় ৫ শতাধিক আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মিথ্যা-মামলার কবলে পড়ে অনেকে জেল-হাজতে আছেন। তারা পদ-বঞ্চিত হয়ে বেতন-ভাতাদি না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। দেশজুড়ে এমন ঘটনায় বিবেকবান মানুষ বিস্মিত ও স্তম্ভিত।

শিক্ষকদের অভিযোগ, সরকার পতনের পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা তাদের বিস্মিত করেছে। পদত্যাগের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা সামনে থাকলেও নেপথ্যে রয়েছে ভিন্ন কারণ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক পদগুলো দখল করতেই শিক্ষকদের আরেকটা অংশই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। অথচ কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও যথাযথ প্রক্রিয়া আছে। সেসবের কোনোটিই অনুসরণ না করে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। কোথাও দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে শিক্ষকদের। শিক্ষকতার শেষ বয়সে এসে সম্মান হারাতে হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও হুমকিস্বরূপ। অনেক শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে ফিরতে চান; কিন্তু আতঙ্কে যেতে পারছেন না।

শিক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব ঘটনার পেছনে একটি সুপরিকল্পিত মব উস্কে দেওয়ার কৌশল কাজ করছে, যার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা হচ্ছে। এতে একদিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নামে পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষকের মর্যাদা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।

সারা দেশে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো সহস্রাধিক শিক্ষক এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে রয়েছেন। এসব ঘটনায় ৬ জন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। এমন পরিস্থিতির শিকার সারাদেশে ২৪০ জন শিক্ষক। এরমধ্যে ১৮৮ জনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ১১২ জনকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছেন না ৫৯ জন। আর জোর করে অবসরে পাঠানো হয়েছে ১৭ জনকে। এছাড়া ১৮৮ জনের মধ্যে প্রায় ১০০ জনের বেতন বন্ধ রয়েছে। বেতন-ভাতা না পেয়ে তারা কষ্টে জীবন-যাপন করছেন বলেও জানা গেছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এসব শিক্ষকের সমস্যা সমাধান করার কথা বললেও বিষয়টি ঝুলে আছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৯ শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জনকে সপদে বহাল করা সম্ভব হয়। গত ২ নভেম্বর ২৩ নভেম্বর সরকার পতনের পর ‘পদত্যাগে বাধ্য’ করার দুই মাস পর ‘হৃদরোগে’ মারা গেছেন চট্টগ্রামের বেসরকারি হাজের-তজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুব। গত ডিসেম্বরে পদত্যাগে বাধ্য করতে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাজেমহল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভীন বেগমকে (৫৪) মারধর করা হয়।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে একটি জ্ঞানবিমুখ, বিশৃঙ্খল প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যা পুরো জাতির জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে।

মধ্যরাতে সক্রিয় প্রোপাগান্ডা চক্র: মধ্যরাত হলেই দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয় একটি সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা চক্র। তাদের স্ট্যাটাসে অস্থিরতা তৈরি হয় বাংলাদেশে।  এই চক্রের নেতৃত্বে আছেন কনক সারওয়ার, পিনাকী ভট্টাচার্য ও ইলিয়াস হোসেন—তিনজনই বিদেশে অবস্থানরত ও বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত।

তাদের ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে রাত গভীর হলেই শুরু হয় রাষ্ট্রবিরোধী গুজব, প্ররোচনা এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা। আর এই বিভ্রান্তিকে চূড়ান্ত রূপ দিতে বসে থাকে সুযোগ সন্ধানী একদল মানুষ। যারা এসব স্ট্যাটাস শেয়ার দিয়ে খেপিয়ে তোলে মানুষকে। আর এরপর থেকে শুরু হয় মব। ওইদিকে সরকারও থাকে নির্বিকার। ভাঙচুর-সংঘাতের পর নাম মাত্র বিবৃতি দিয়ে পার পেয়ে যায় তারা। এটি এখন বাংলাদেশের চিত্র।

বিশ্লেষকদের মতে,এটি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, বরং একটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহমূলক প্রচেষ্টা, যেখানে সামাজিক বিভ্রান্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।”

দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা নতুন কিছু নয়, তবে যখন সেটি একটি সংগঠিত চক্রান্তে রূপ নেয়, তখন তা গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ইউনূস গংয়ের বিরুদ্ধে যেভাবে ‘মব উস্কানি’ দিয়ে জাতীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্টের অভিযোগ উঠেছে, তা শুধু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য নয়, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্যও হুমকি স্বরূপ। আইন ও বিচারব্যবস্থার আশ্রয়ে থেকে এই ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি, যাতে কোনো গোষ্ঠী ভবিষ্যতে আর রাষ্ট্রবিরোধী নীলনকশা আঁকার সাহস না পায়।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আসিফের ব্যাগ থেকে পাওয়া গেছে একে-৪৭ এর অ্যামোনেশন ম্যাগজিন

1

কোটায় অস্ত্রের লাইসেন্স আসিফ মাহমুদের?

2

ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি, নেপথ্যে অর্থনীতিবিদ ইউনূস

3

ইউনূসের জঙ্গি সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল শিক্ষার্থীরা

4

নসিপি ও বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মে নিরাপদ নয় নারী নেত্রীরা

5

১৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তির চিন্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

6

দুদক ধ্বংসে মরিয়া ইউনূস গং

7

বিমানবন্দরে আসিফ মাহমুদের ব্যাগে অ্যামোনেশন ম্যাগজিন শনাক্ত

8

খলিল-ইউনূসের প্রেস উইংয়ের মিথ্যাচার উন্মোচন করল সেনা সদর

9

৯ মাসে পুঁজিবাজারে মূলধন কমেছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা

10

ইউনূস-লামিয়া মোর্শেদ সিন্ডিকেটে ধ্বংসের মুখে দেশের শ্রম বাজা

11

কারা ও পুলিশ হেফাজতে ২৬ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা

12

ইউনূসের আসকারায় থানায় মিথ্যা মামলার হিড়িক, উদ্বিগ্ন বিশ্লেষক

13

ইউনূসের মদদে ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির রাজত্ব; রুখব

14

‘ছয় মাসের বেশি টিকবে না—এসব শুনতে শুনতে ১০ বছর কাটিয়ে দিলাম’

15

এক সময় মানবাধিকারের মুখপাত্র আসদুজ্জামান এখন মবের হোতা?

16

মার্কিন অর্থায়নে আরাকান আর্মিকে অস্ত্র দেবে তুরস্ক, বাস্তবা

17

ইউনূসের রাষ্ট্রীয় দুর্বলতায় বাড়ছে মন্দিরে হামলা; জঙ্গিবাদের

18

মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রে ইউনূস-খলিল গোষ্

19

বাংলাদেশে চলছে চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, ডাকাতি ও মবের রাজত্ব

20