নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী আগস্টে মালয়েশিয়া সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এই সফর নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাঝে। অনেকের আশঙ্কা, এই সফরের পর মালয়েশিয়াও শ্রমবাজার সংকোচনের পথে যেতে পারে, যেমনটি অতীতে একাধিক দেশে সফরের পর ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূলত জুলাই মাসে সফরের প্রস্তাব ছিল, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ আনুষ্ঠানিক কর্মসূচির কারণে তা পিছিয়ে আগস্টে নেওয়া হয়।
সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরের প্রস্তাব ছিল। তবে জুলাইয়ে দেশে বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রামের কারণে আগস্টে তার সফরের প্রস্তাব করেছে ঢাকা।
কথা ছিল ইউনূস দেশকে নিয়ে যাবেন একটি নতুন সম্ভাবনার পথে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই অনেক প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ। তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে আর এই বিতর্কগুলো তিনি নিজেই সৃষ্টি করছেন। তিনি নিজের স্বার্থ যতটুকু দেখছেন, জনগণের স্বার্থ ততটা দেখছেন না—এমন অভিযোগ অনেকের। বিগত সরকারের আমলে করা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারাধীন সব মামলা এই সময়ে প্রত্যাহার হয়েছে, না হয় আদালত বাতিল করেছেন।
শ্রমবাজারে নতুন সিন্ডিকেট
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাতটি বর্তমানে এক নতুন সিন্ডিকেটের চাপে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সহচর লামিয়া মোর্শেদ, যিনি বর্তমানে এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক পদে রয়েছেন। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে একটি স্পর্শকাতর ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন একজন ব্যক্তি অধিষ্ঠিত হলেন, যার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন।
সফর ব্যক্তিগত, খরচ রাষ্ট্রীয়
সূত্র মতে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে বারবার বিদেশ সফরে যাচ্ছেন ড. ইউনূস। যদিও এসব সফর মূলত ব্যক্তিগত বলে ধারণা করা হয়, তবে প্রত্যেক সফরে তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্ত হচ্ছেন লামিয়া মোর্শেদ। বহুল আলোচিত লন্ডন সফর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে প্লেনভর্তি সঙ্গী নিয়ে তিনি অংশ নেন। এ পর্যন্ত ইউনূসের কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সফরে অনুপস্থিত ছিলেন না লামিয়া।
২০২৪ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই ইউনূস তার নিকটজনদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোর্শেদকে নিয়োগ দেওয়া হয় এসডিজি মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে। অথচ এসডিজি বাস্তবায়নে তাঁর কোনো উল্লেখযোগ্য দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস: একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার?
সাম্প্রতিক সময়ে জনশক্তি রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে ড. ইউনূসের মালিকানাধীন গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড (GESL)। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সালেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল, যা তখনই বাতিল হয়। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে হঠাৎ করেই জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি।
এই অনুমোদনের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব ও লবিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ করে ড. ইউনূস ও লামিয়া মোর্শেদের প্রভাব ব্যবহারের প্রসঙ্গ নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি জনশক্তি রপ্তানির নামে মূলত সিন্ডিকেট ব্যবসায় যুক্ত এবং দেশের অন্যান্য এজেন্সিগুলিকে বাজার থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিএমইটির এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সিন্ডিকেট রাজত্ব এবং প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে বিগত এক বছরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
তিনি বলেন, “এখন শ্রমবাজারে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত ইউনূসের ঘনিষ্ঠরা। লামিয়া মোর্শেদকে সামনে রেখে একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে যারা সরকারি সফরের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক জনশক্তি বাজারে প্রভাব বিস্তার করছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও নীতিগতভাবে ভয়াবহ। শ্রমবাজারে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আস্থা হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে শ্রমবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। দেশের অন্যান্য বৈধ জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একইসাথে সরকারি পদ ব্যবহার করে বেসরকারি স্বার্থ চরিতার্থ করার বিষয়টি গভীর উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে।
একজন বিশ্লেষক বলেন, “যদি এই সিন্ডিকেটিক নিয়ন্ত্রণ চলতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে জনশক্তি রপ্তানিতে স্বচ্ছতা থাকবে না। ইউনূসের প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা বা সাহস কেউ দেখাতে পারবে না, কারণ রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তিনি একজন অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এটা বুঝতে কারো অসুবিধা নেই, প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কারণে উল্কার গতিতে এসব সম্ভব হয়েছে। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার মামলাগুলোর বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আমলে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের কাজে গতি নেই। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে ধীরগতি সবাইকে ব্যথিত করেছে। বিএনপির বহু নেতা বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা, এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনে যেসব মামলা করা হয়েছিল সেসব মামলা প্রত্যাহারে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলামুক্ত হতে সময় লেগেছে ১০ মাস। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মাত্র এক মাসের মধ্যে তাঁর সব মামলা প্রত্যাহার করান।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে যে ৬৬৬ কোটি টাকার কর আরোপ করা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর তা মওকুফ করিয়ে নেন তিনি। এই সময় গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের যে শেয়ার ছিল তা তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। এই কাজটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানকে কেন করতে হবে? গ্রামীণ ব্যাংক প্রধান উপদেষ্টার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, এটি সবার জানা। ফলে এ ধরনের অধ্যাদেশ কি স্বার্থের সংঘাত হলো না? একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর যদি এটি করত তাহলে বিষয়টি অনেক শোভন হতো বলে মনে করে অনেকে। এ সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রিক্রুটিং এজেন্সির অনুমতি পেয়েছে, পেয়েছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন। এভাবে একের পর এক সুবিধা নেওয়া কতটা শোভন হয়েছে?
এই সময়ের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০ বার বিদেশ সফর করেছেন। বিশ্বের উন্নত দেশ, যাঁরা বিশ্বকূটনীতিতে নেতৃত্ব দেন, যাঁরা বিশ্বের মুরব্বি, তাঁদের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরাও ১০ মাসে এতবার বিদেশ সফর করেননি। সে ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা নিঃসন্দেহে একটি অনন্য রেকর্ড স্থাপন করেছেন। কিন্তু এসব সফরে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সময়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ হয়ে গেছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ করেছে। এমনকি থাইল্যান্ডের ভিসা যেন এখন সোনার হরিণ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দিল্লি থেকে ইউরোপের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকেই যেন তাঁরা ভিসা ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চালান সেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওই অনুরোধে কেউ সাড়া দেননি। বরং ইউরোপের ভিসা এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব খাটানোর প্রবণতা শ্রমবাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ। এতে উদ্যোক্তারা যেমন আস্থা হারাচ্ছেন, তেমনি দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মন্তব্য করুন