সাইফুল ইসলাম
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সুযোগে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গঠনের সাথে সাথেই সরকার জাতির উদ্দেশ্যে বলেছিল এই সরকারের উদ্দেশ্য একটি নিরপেক্ষ ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা, যদিও এই বক্তব্যের নূন্যতম বাস্তবতা রাজনৈতিক, সামাজিক আর্থিক সহ কোন খাতেই দেখাতে পারেনি সরকার, এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অকল্পনীয়ভাবে অতিদ্রুত সময়ে চরমে পৌঁছে গেছে। পাশাপাশি দেশের সার্বিক বিষয়াদির ন্যায় অল্প সময়ের ব্যবধানে এই সরকারের আর্থিক সক্ষমতা ও নীতিগত দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক অবনমন, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পটভূমি ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই ‘নৈতিক ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা’র ধ্বজা বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা ছিলো দৃশ্যমান বাস্তবতায় শূন্য - যার ইমিডিয়েট ইফেক্ট ফুটে ওঠে আর্থিক খাতে। অর্থনৈতিক নীতিমালায় অস্পষ্টতা, বাজেট বাস্তবায়নে অদক্ষতা এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে সঠিক সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার গঠনের পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থই ছিলো মূখ্য। সাথে আন্তর্জাতিক বিষয়াদি জড়িত থাকলেও অর্থনৈতিক কৌশল ও নীতিগত প্রস্তুতি ছিল অসম্পূর্ণ।
চলমান আর্থিক সংকটের মূল কারণসমূহ
১. বিনিয়োগে স্থবিরতা ও বাজারের আস্থাহীনতা
সরকার গঠনের পরপরই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, দখল লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ, সন্ত্রাস রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। পাশাপাশি স্বচ্ছ সার্বজনিন বিনিয়োগ বা ব্যবসা বান্ধব নীতির অভাব ব্যবসায়ী ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে, ডলার রেমিট্যান্স হ্রাস পায় এবং বৈদেশিক ঋণ পেতে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান স্পষ্ট হয়।
তথ্যসূত্র:
২. আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্যহীনতা
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার পেছনে একটি প্রধান কারণ হলো আমদানি নির্ভরতা এবং রপ্তানির সংকোচন। প্রতিবেশী ও বন্ধু দেশ সমূহের সাথে অযাচিতভাবে সম্পর্কের বৈরিতা সৃষ্টি এবং স্বার্থপর ও পশ্চাদগামী দেশের সাথে ভারসাম্যহীন সম্পর্ক চলমান অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যা আস্থায় ফাটল সৃষ্টি করে - আর এতেকরে তৈরি পোশাক খাতে ক্রেতাদের আস্থাহীনতা, শ্রমিক অসন্তোষ এবং ডলারের অস্থিরতায় অর্ডার কমে গেছে।
তথ্যসূত্র:
৩. মুদ্রাস্ফীতি ও জনজীবনের চাপে
FAO-এর তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ। জ্বালানি ও কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি গ্রামীণ অর্থনীতিকে ভয়াবহ নাজুক অবস্থায় ফেলেছে।
৪. নীতিগত দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা
অন্তর্বর্তী সরকারের আর্থিক বিভাগ একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ত্রাণ বিতরণ, ভর্তুকি প্রদান ও কৃষিখাতে প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। এই নীতিহীনতা সংকটকে গভীর করে, যার দায় একান্তই সরকারের।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
১. বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি-এর মূল্যায়ন
বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে যে বাজেট ঘাটতি ৬.৯% ছাড়িয়ে গেছে, যা বাংলাদেশ আর্থিক ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক দশকে সর্বোচ্চ। আইএমএফ শর্তসাপেক্ষে সহযোগিতা প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এযাবৎ সরকার শুধুমাত্র সহযোগিতা ও সম্পর্কের কথা বললেও শর্ত জাতির সম্মুখে প্রকাশ করেনি, যাতে করে জনমনে শংকা সৃষ্টি হচ্ছে।
তথ্যসূত্র:
২. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ
The Economist-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘The Fragile Middle Path of Yunus’s Interim Government’ শিরোনামে লেখা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘ড. ইউনূস তাঁর খ্যাতির চেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় প্রস্তুতি ছাড়াই দায়িত্ব নেওয়ায় তিনি এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা’। এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বা অগ্রগতির কোন পদক্ষেপ না থাকলেও রাজনৈতিকভাবে সমর্থন পাওয়ার তাঁর যাচ্ছেতাই প্রচেষ্টা সংকটকে স্থায়ী পরিণতর দিকে ধাবিত করছে যা বাংলাদেশের আগামীকে নিশ্চিতভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করবে।
বাস্তব চিত্র ও ক্ষেত্রভিত্তিক প্রভাব
তৈরি পোশাক শিল্পে বিপর্যয়: ৩০% -এরও বেশি রপ্তানি আদেশ বাতিল, ১০০টির বেশি কারখানা বন্ধ ( মব সন্ত্রাস অরাজকতা লুটপাট যার অন্যতম কারণ)।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস: ধান, আলু, পেঁয়াজের দাম উৎপাদক পর্যায়ে কমলেও বাজার অসহনীয় রকমের চড়া। বীজ, কৃষিপন্য ও সারের দাম বেড়েছে ৪০%।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ঘাটতি: রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এলসি খোলা যাচ্ছে না, আসছেনা বিদ্যুৎ উৎপাদন মালামাল ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে।
নতুন যুক্ত দৃষ্টিকোণ
১. রাজস্ব সংগ্রহ ও কালো টাকার প্রভাব
বর্তমান রাজস্ব আদায়ের হার জিডিপির মাত্র ৭.৮%, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এর ফলে সরকারি ব্যয় সংকুচিত হচ্ছে ( উন্নয়ন ব্যয় সংকুচিত হলেও বিলাসিতা ও অযাচিত অপ্রয়োজনীয় ব্যয় চলছে লাগামহীন)। কালো টাকার প্রবাহ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে আস্থা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। দুর্নীতি তো ওপেন সিক্রেট, সরকার সংশ্লিষ্ট শুধু নয় সরকার সমর্থিত যেকেউ চাইলেই যা ইচ্ছে যেভাবে ইচ্ছে করতে পারে।
২. তরুণ সমাজ ও কর্মসংস্থান
শিক্ষিত উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিআইডিএস (BIDS) এর এক জরিপ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে স্নাতকধারী তরুণদের ৪৮% কর্মহীন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় মেধাপ্রবণদের দেশত্যাগও বেড়েছে। ড. ইউনূস সরকার এই বিষয়ে নূন্যতম কোন পদক্ষেপ নেয়নি, উল্টো সরকারের দেয়া ‘অটোপাশ’ জাতির আগামীকে মেধা প্রতিযোগিতা শ্রমহীন এক দুর্নীতি প্রবণ অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংকট নিরসনের শপথ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও - উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চরম দুর্বলতা ও পরিকল্পনাহীনতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত করছে ।
তথ্যসূত্র:
১. World Bank Country Report, 2025
২. BGMEA Fact Sheet, Q2 2025
৩. IMF Fiscal Review, 2025
৪. The Economist, Reuters, Al Jazeera
৫. BIDS Youth Employment Survey, 2025
৬. Bangladesh Bank Monthly Reserve Update, June-2025
মন্তব্য করুন