লন্ডন ও ঢাকা থেকে প্রতিবেদক
নির্বাচনের দাবি জানিয়ে মাঠে নামা বিএনপি এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কৌশলগত ফাঁদে পড়েছে। সম্প্রতি চ্যাথাম হাউসে দেওয়া ইউনূসের বক্তব্য এবং তারেক রহমানের সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠক—এই দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির অবস্থান দুর্বল হয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
যুক্তরাজ্য সফরের ঠিক একদিন আগে ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করেন, দেশের জনগণ চান ইউনূস আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুন। একইসঙ্গে ভিডিওতে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের “দালাল” ও “বিদেশি শক্তির প্রোক্সি” বলে উল্লেখ করে সরাসরি আক্রমণ করা হয়।
এরপর লন্ডনে পৌঁছে চ্যাথাম হাউসে দেওয়া ভাষণে ইউনূস স্পষ্টভাবে নির্বাচনকে গৌণ ও ‘সংস্কার’ এবং ‘বিচার’কে মুখ্য বলে উল্লেখ করেন। এই বক্তব্য শুধু নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার বার্তা নয়, বরং ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত এনসিপিকে আরো সুসংহত করার ইঙ্গিত হিসেবেও ধরা হচ্ছে।
এনসিপির দুই শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম ও হাসনাত আবদুল্লাহ আগে থেকেই বলে আসছিলেন, নির্বাচন নয়—প্রথমে সংস্কার। বিএনপির পক্ষ থেকে যখন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি আসছে, ঠিক তখন ইউনূসের এমন অবস্থান বিরোধী পক্ষের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা একটি কৌশলগত অবস্থান—যেখানে ইউনূস নিজেকে মধ্যস্থতাকারী দেখিয়ে, বিএনপিকে আলোচনায় বসিয়ে আসলে একটি অনির্বাচিত ব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত করার পথ তৈরি করছেন। ইউনূসের প্রস্তাবিত ‘জুলাই চার্টার’ নিয়ে ঐকমত্যকে শর্ত বানিয়ে তাতেও এনসিপির অবস্থানকে জোরদার করার কৌশল রয়েছে।
ভোটারদের বিষয়ে তাঁর মন্তব্য—“টাকা দিয়ে কেনা যায়”—দেশের গণতন্ত্র ও ভোটারদের প্রতি অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ। এটা নির্বাচন নয়, ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টা—এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।
তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ইউনূসের দল এটিকে রাজনৈতিক “গেম চেঞ্জার” বললেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি মূলত বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশল। একইসঙ্গে, সরকারের তরফ থেকে তারেকের দেশে ফেরার পথে বাধা নেই বলেও জানানো হয়েছে—যা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
গত দশ মাসে বিএনপিকে “রাষ্ট্রবিরোধী”, “বিদেশি এজেন্ট” বলেও আক্রমণ করা হয়েছে ইউনূস ও এনসিপির পক্ষ থেকে। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে আলোচনার প্রস্তাব—এটিকে রাজনৈতিক “প্রতারণা” বলেই ব্যাখ্যা করছেন অনেকে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউনূস বুঝতে পেরেছেন যে, এনসিপি এককভাবে জনগণের সমর্থন আদায় করতে পারবে না। তাই বিএনপিকে আলোচনায় টেনে এনে, চার্টার স্বাক্ষর করিয়ে, একটি আপাত রাজনৈতিক ঐক্য দেখিয়ে নিজের অনির্বাচিত শাসন আরও সময় টিকিয়ে রাখতে চান তিনি।
তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে—বিএনপি কি ইউনূসের এই কৌশল বুঝে উঠেছে, নাকি তারা আসলেই তাঁর ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে?
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক কৌশল, বিশেষ করে নির্বাচন বিলম্ব ও এনসিপিকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রক্রিয়া, বিএনপিকে এক ধরনের কৌশলগত ফাঁদে ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিএনপি আলোচনায় অংশ নিয়ে আপাত রাজনৈতিক লাভের আশায় থাকলেও, বাস্তবে তারা ইউনূসের অনির্বাচিত শাসন দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনাকে বৈধতা দিচ্ছে কিনা—সে প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মন্তব্য করুন