সাইফুল ইসলাম
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট - এই তারিখটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন কলঙ্কের দিন হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এই দিনে নির্বাচিত সাংবিধানিক সরকারকে হটিয়ে একপাক্ষিকভাবে ৮ আগষ্ট একটি কথিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ ক্ষমতা গ্রহণ করে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বহুল আলোচিত সমালোচিত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রের বাহ্যিক কাঠামো ঠিক থাকলেও, অভ্যন্তরে নেমে আসে এক ভয়ঙ্কর অরাজকতা, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের সূক্ষ্ম কিন্তু সুসংগঠিত চক্রান্ত।
৫ আগস্ট ২০২৪-এর আগে থেকেই কিছু ‘পলিটেকনোক্র্যাট’ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক সরকার’ গঠনের পরিকল্পনা চলছিল। ওয়াশিংটনের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ গবেষক জেফরি স্যাক্স এর সাক্ষাৎকার (Al Jazeera, Sept 2024) অনুযায়ী, এই সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ‘মার্কিন ডীপ স্টেট’ এর ভূমিকা ছিল সক্রিয়। স্যাক্স বলেন, ‘This interim arrangement in Bangladesh is part of a quiet U.S. strategy for rebalancing regional influence, particularly after the Indian shift.’
তাঁর মতে ড. ইউনূসের নোবেল খ্যাতির আড়ালে ‘সুশীল মোড়কে মোড়া প্রজেক্ট’ চালু হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল -
৫ আগস্টের পরপরই প্রথম যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারানো। অধিকাংশ সচিবালয়, পুলিশ বিভাগ, এবং স্থানীয় প্রশাসন বেসামাল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী -
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়কে অনেকে তুলনা করেছেন ২০০৭-২০০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের সঙ্গে। তবে এবার পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়ানক, যার সাথে ১৯৭১ এ পাক-হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস এর ধ্বংসযজ্ঞ মনে করিয়ে দেয়।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই প্রশাসন জাতীয় বাজেট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। অর্থনীতিবিদ ড. সালাহউদ্দিন খান ২০২৫ সালের শুরুতে বলেন, “এই সরকার দেশের অর্থনীতিকে বেসরকারিকরণের নামে আন্তর্জাতিক লুটপাটের সুযোগে পরিণত করেছে।” (The Daily Star, Jan 2025)-
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াও একটি কেন্দ্রীয় ‘মনিটরিং ইউনিট’-এর অধীনে চলে যায়। সাইবার নিরাপত্তার নামে নতুন এক ধরণের ‘ইন্টারনেট সেন্সরশিপ’ চালু হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল -
প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান AccessNow এর ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়: ‘Bangladesh witnessed one of the most sophisticated forms of digital surveillance in the region after August 5, 2024.’
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কিছু মার্কিন সংস্থা প্রকাশ্যে এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করে, যদিও মাঠের বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি প্রমাণ করে যে - বাংলাদেশকে একটি নিয়ন্ত্রিত উপনিবেশ বানানোর পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি। সমুদ্র সম্পদ, রোহিঙ্গা ভূখণ্ড এবং চীন-ভারত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্বই এখন প্রধান লক্ষ্য।
ভারতের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন এক সেমিনারে বলেন, “The U.S. is shaping a pliant regime in Dhaka as part of its Indo-Pacific strategy.” (CSIS Seminar, Nov 2024)
দেশব্যাপী ইউনূস প্রশাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে মানুষ জেগে ওঠে। ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে শুরু করে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত অন্তত ৬৮টি জেলা শহরে বিক্ষোভ হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #StepDownYunus #BackToConstitution এবং #NoToColonialGovt ট্রেন্ড করে।
বিশেষ করে শিক্ষার্থী, কৃষক এবং শ্রমজীবী সাধারণ নাগরিকরা সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
৫ আগস্ট ছিল এক প্রকার 'ন্যাশনাল হাইজ্যাক'। রাষ্ট্রের, প্রশাসনের, অর্থনীতির এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে মানুষের মুক্তি স্বাধীনতা ও স্বাধীনচিন্তার অপহরণ। এই দিন বাংলাদেশের মানচিত্রে একটি শকুনের থাবা এঁকে দিয়েছিল - যা শুধু ভূখণ্ড নয়, একটি জাতির ভবিষ্যতকে বন্দি করে নেয়।
তবে ইতিহাস বলে, চক্রান্ত যত গভীরই হোক, মানুষ যখন জাগে, তখন সব ষড়যন্ত্র ভেসে যায়। ৫ আগস্টের এই কালো অধ্যায়ও একদিন ইতিহাসে লেখা হবে ‘ব্যর্থ শকুনের গল্প’ হিসেবে - সেই দিনটির অপেক্ষায় রয়েছে এই জাতি।
তথ্যসূত্র :
1. Al Jazeera Interview with Jeffrey Sachs, Sept 2024
2. BDLeaks – Internal Administrative Reports (leaked)
3. Human Rights Focus Bangladesh, Annual Report 2024
4. Ain o Salish Kendra, Case Files 2024
5. Bangladesh Bank, Quarterly Financial Statement (Q4, 2024)
6. The Daily Star, Jan 2025
7. CSIS Seminar on Indo-Pacific Realignment, Nov 2024
8. AccessNow: Digital Rights in South Asia, 2025
সাইফুল ইসলাম: লেখক, কলামিস্ট
মন্তব্য করুন