নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাবকে ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বইছে। এই ইস্যুতে বিএনপি স্পষ্টভাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেছিল। করিডোরের মাধ্যমে দেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে তারা এই দাবি তোলে এবং ঢাকায় আন্দোলনেরও ডাক দেয়।
কিন্তু সম্প্রতি লন্ডনে একটি নাটকীয় দৃশ্যপটের অবতারণা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেড় ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। আর আশ্চর্যের বিষয়, বৈঠকের আগে সেই বিতর্কিত খলিলুর রহমানই তারেক রহমানকে বরণ করে নেন এবং বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন।
ড. খলিলুর রহমান একজন মার্কিন নাগরিক যিনি অস্থায়ী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে তাকে করিডোর পরিকল্পনায় মূল ষড়যন্ত্রকারী বলে দাবি করে আসছে। অথচ তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে ইউনূস তাঁকেই সঙ্গে রাখেন এবং আলোচনার মূল ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি ছিল ইউনূসের পূর্বপরিকল্পিত কৌশল—বিএনপিকে বিভ্রান্ত করে করিডোর ইস্যুতে নীরব সম্মতি আদায় করার। এমনকি সংবাদ সম্মেলনেও খলিলুর রহমানকে উপস্থাপন করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়, বিএনপির আর বর্তমান প্রশাসনের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
বৈঠকের সময় ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ লেখা পোস্টার নিয়ে ইউনূসের লন্ডন অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বিএনপির নেতারা। কিন্তু বৈঠকে খলিলুরের উপস্থিতি এবং তার সঙ্গে আলোচনা, তারেক রহমানের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দলীয় ভেতরে ও বাইরে।
চ্যাথাম হাউজে এক আলোচনায় ইউনূস বাংলাদেশের ভোটারদের ‘টাকার বিনিময়ে ভোট দেওয়া’ বলে অপমান করেন—যা অনেকের কাছে নির্বাচনের পরিবর্তে ক্ষমতায় থাকার দুরভিসন্ধির ইঙ্গিত বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এক দিন পরই, এই ‘ভোট বিক্রি’ শব্দগুলো বলার পর, ইউনূস ইউ‑টার্ন নেন। তারেকের সঙ্গে বৈঠকে তিনি রমজানের আগেই নির্বাচন করতে সম্মতি দেন, কিন্তু শর্ত দেন—সকল প্রস্তুতি আগেই সম্পন্ন হতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে ‘কৌশলগত ভেল্কি’ এবং ‘বিএনপিকে বিভ্রান্ত করার ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন।
এই সফরের শুরুতেও ইউনূস এমন আরেকটি প্রতারাণা করিয়েছিলেন তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল ইসলামকে দিয়ে। প্রেস সচিব বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার কানাডায় থাকায় তাঁর সঙ্গে ইউনূসের সাক্ষাৎ হবে না। অথচ তিনি লন্ডনেই ছিলেন।
তারেক-ইউনূস বৈঠকের ঠিক আগের দিন ইউনূসের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ঘোষণা দেন—তারেক রহমান চাইলে দেশে ফিরতে পারবেন। অথচ গত দশ মাস ধরে অস্থায়ী প্রশাসন তার দেশে ফেরা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছিল। অনেকেই বলছেন, এই আকস্মিক নমনীয়তা ‘ব্ল্যাকমেইলের একটি রূপ’।
বিএনপির অনেক স্থানীয় নেতা এ বৈঠক ও তারেক রহমানের অংশগ্রহণে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, এই বৈঠক ইউনূসের একক ও বিতর্কিত পরিকল্পনাগুলোর প্রতি সমর্থন হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে—যেমন করিডোর বা বন্দরের লিজ।
বিএনপির ভেতর থেকেই নেতারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন—করিডোর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতো ইস্যুতে বিএনপি যদি আর সরব না থাকে, তাহলে জনগণের কাছে দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এক নেতা বলেন, ‘যদি আমরা করিডোরসহ এইসব রাষ্ট্রবিরোধী ইস্যুতে অবস্থান পরিবর্তন করি, তাহলে জনগণ আমাদের বিশ্বাসঘাতক ভাববে।’
অন্য এক নেতা বলেন, ‘খলিলুর রহমানের উপস্থিতি ও সংবাদ সম্মেলনে তার অংশগ্রহণ আমাদের জন্য আত্মঘাতী। আমরা যে ব্যক্তি ও নীতির বিরুদ্ধে এতদিন প্রচার চালিয়েছি, আজ তাকেই বৈঠকের মুখ করে উপস্থাপন করা হলো।’
মন্তব্য করুন