Insight Desk
প্রকাশ : Jul 1, 2025 ইং
অনলাইন সংস্করণ

গণমাধ্যমের দায়হীনতা ও প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী শাসনে ‘সংবাদ’ নামক গুজবশিল্প

 সাইফুল ইসলাম 

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা যেন এক সম্পূর্ণ নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। গণতন্ত্রের নামে, গণমানুষের হয়ে কথা বলার নামে যে সাংবাদিকতা একসময় অন্ততপক্ষে দায়িত্ববোধ মেনে চলত, সেটি আজ গুজব গল্প লেখার এক লাইসেন্সপ্রাপ্ত শিল্পে পরিণত হয়েছে। আর সেই গল্পের উপজীব্য “ধারণা করা হয়”, “বিশেষজ্ঞ মনে করেন”, “সূত্র জানায়” এই তিনটি বাক্যাংশ। এই শব্দগুলোই এখন একেকটি তথাকথিত সংবাদ পরিবেশনের কেন্দ্রবিন্দু, যার মধ্যে প্রমাণ, অনুসন্ধান, কিংবা পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের বক্তব্যের কোনো অস্তিত্ব নেই।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি একসময় ক্ষুদ্রঋণের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই আজ অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রধান হিসেবে এমন এক শাসনব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছেন যার ভিত নৈতিক দায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতায় নয় বরং ‘ন্যায়নীতিহীন নীতিবোধ’ ‘ সুশীল মুখোশে অভিজাত সামাজিক আবর্জনা’ ও ‘আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ভ্রান্ত ধারণা’র উপর দাঁড় করানো। তাঁর সরকার একটি অন্তর্বর্তী পর্যায়ের প্রশাসন হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরেই দেশজ মিডিয়া এবং তথাকথিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একটি গল্প নির্ভর বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, যার সম্পূর্ণ কলকাঠি পরিচালিত হয় তাঁরও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণ সেন্টার’ থেকে। 

এই গল্পগুলোতে থাকে, কোনো এক “বিশেষজ্ঞ” এর উদ্ধৃতি, যার পরিচয় প্রকাশ করা হয় না - হলেও এদের বিষয়ে জনগণ কিছুই জানেনা। এরপর কোনো এক “সূত্র”, যার যাদের অবস্থান নিশ্চিত নয়; অথবা কোনো এক “গবেষণা” যা কোনো সময়, স্থান বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়া উপস্থাপন করা হয়। এই সমস্ত তথাকথিত তথ্য উপস্থাপন করা হয় একটি পূর্বনির্ধারিত বক্তব্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কার্যত গুজব-ভিত্তিক ‘পোস্ট-ট্রুথ’ সাংবাদিকতায় পরিণত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বলতে বোঝায় এমন এক অবস্থা যেখানে মানুষের আবেগ, বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত মতামত প্রাধান্য পায় বস্তুগত সত্য, তথ্য ও যুক্তির ওপর। বর্তমানে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা সেই দিকেই ধাবিত হয়েছে - যেখানে সত্য যাচাইয়ের আগেই সংবাদ প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

প্রতিদিন গণমাধ্যমে এমন সব সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে যার উৎস ‘সম্ভাব্য সূত্র’ বা ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি’। উদাহরণস্বরূপ, “বিরোধী রাজনৈতিক মতের ষড়যন্ত্র বা গোপন চরম সিদ্ধান্ত”, “সাবেক কর্মকর্তার মুখে অস্বস্তিকর তথ্য”, “নির্বাচনের আগে গোপন পরিকল্পনা বা নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র”, “ অমুক দেশের স্বার্থে তমুকের দেশ বিরোধী চুক্তি বা স্বার্থ রক্ষা “ - এই ধরনের শিরোনাম বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, এগুলোর মূল ভিত্তি কোনো দলিল নয়, বরং মিথ্যা বানোয়াট ও ক্ষেত্রবিশেষে অনুমান নির্ভর এবং চুরান্ত সত্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত ব্যাখ্যা।

এক সময় সাংবাদিকতা ছিল নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা ও সত্যের সন্ধানে এক পেশাগত শৃঙ্খলা। কিন্তু বর্তমানে এই ধারার জায়গায় এসেছে সাংবাদিকতার নামে রাজনৈতিক দালালি, মব পৃষ্ঠপোষকতা এবং সর্বোপরি বিকৃত বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠা করার এক সুসংগঠিত অপপ্রয়াস।

জাতীয় প্রেসক্লাব, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানেল - সর্বত্রই এখন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সাংবাদিকদের একাংশ এখন আর সমাজের ভাষ্যকার নয়; বরং হয়ে উঠেছেন সামাজিক বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী সমাজ ও দেশ বিরোধী প্রপাগান্ডাবিদ।

বিশেষ করে ‘নির্ভরযোগ্য সূত্র’ নামক এক অবাস্তব পরিচয়ের আড়ালে একেকটি সংবাদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র হনন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে অবমূল্যায়ন এবং সামাজিক বিভক্তি ঘটানোর অপপ্রয়াস চলছে

বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান কিংবা ইকোনমিস্ট-এর মতো প্রায় সকল বৈশ্বিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কিত রিপোর্টে এখন প্রাধান্য পাচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতার সংকোচন এবং ‘সম্ভাব্য স্বৈরতন্ত্র’ ইত্যাদি অভিযোগ। অথচ প্রফেসর ইউনূসের ও তাঁর প্রেস উইং প্রতিনিয়ত উদ্ভট অবান্তর মনগড়া বানোয়াট ও সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত কল্পকাহিনির আসর বসিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে ।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ‘গ্লোবাল অপিনিয়ন’ গঠনের নামে চলছে নোংরা এক অপতৎপরতা, এবং এটি অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যেখানে অধিকাংশ শুধু নয় সকল রিপোর্টেই নেই কোনো স্বতন্ত্র অনুসন্ধান, নেই স্থানীয় বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা। বরং, এই রিপোর্টগুলোতেও “অজ্ঞাতসূত্র”, “বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ” বা “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিক” অথবা “সুবিধাবাদী সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্টকারীদের” দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক চিত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে - যা একদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে ভাঙছে, অপরদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও জটিল করে তুলছে।

বর্তমানে যেসব বিষয় সবচেয়ে বেশি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে: রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, ৫ আগষ্ট ২০২৪ পূর্ববর্তী বিরোধী দলগুলোকে হঠাৎ অতিমাত্রায় “গণতন্ত্রপ্রিয়” ও “নির্যাতিত” হিসেবে উপস্থাপন, অথচ অতীতে তাদের গৃহীত সহিংসতা, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীনতা ও দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড উপেক্ষিত। ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু বিষয়ে গুজব মিথ্যা অপপ্রচার। যেকোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন। মব সন্ত্রাস অরাজকতাকে “মব জাস্টিস” বলে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্যে সমর্থন। 

অর্থনৈতিক সংকট, ডলারের দাম, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি - সবকিছুই কেবল অনুমানের ভিত্তিতে প্রচার করে জনমানসে ভীতি সৃষ্টির প্রবণতা।

এইসব বিকৃত তথ্য, গুজব ও প্রচারণার প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজে দেখা দিচ্ছে গণবিভ্রান্তি, বিভেদমূলক মতামতের বিস্তার, সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আস্থার সংকট, তরুণ প্রজন্মের মাঝে হতাশা এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষয়।

এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠে, বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কি অন্তত প্রফেসর ইউনূসের শাসনকালে সত্যের পথে ফিরে যেতে পারবে ? প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার কি আদৌ গণমাধ্যমকে একটি নিরপেক্ষ, জবাবদিহিতামূলক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করতে চায়? নাকি এই ‘গুজব গল্প লেখার লাইসেন্স’ ব্যবহার করে তারা শুধু নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে চায়?

বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ - গণমাধ্যমকে দায়িত্ববান, পেশাদার এবং জনমুখী একটি কাঠামোতে ফিরিয়ে আনা। গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে সাংবাদিকতাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আগামী দিনের বাংলাদেশ শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও এক অস্থির, ভারসাম্যহীন, ও বিভক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

প্রফেসর ইউনূসের শাসনের সময়ের সাংবাদিকতা প্রমাণ করে দিয়েছে - তথ্যহীন অনুমানভিত্তিক সংবাদ কেবল একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্র নয়, জাতির ভবিষ্যত চিন্তাধারাকেও ধ্বংস করতে পারে। সংবাদমাধ্যম যখন তথ্যপ্রমাণ ছেড়ে কল্পনার আশ্রয় নেয়, তখন সেটি হয়ে ওঠে একটি "অপশিল্প" যেখানে গল্প বলা হয়, কিন্তু সত্য প্রকাশ হয় না।

এটি কেবল সাংবাদিকতার নয়, সমগ্র জাতির জন্য জাতীয় বিপর্যয়।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৬০০ কোটি টাকার হাসপাতাল এখন জুলাই আহতদের ‘আবাসিক হোটেল’

1

বিএনপিকে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছে তারেক, গেইনার শুধুই ইউনুস

2

মবকে বৈধতা দিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

3

বৈষম্যবিরোধীরাই দেখাল, আন্দোলনে রোহিঙ্গা ও বিহারীদের ভূমিকা

4

জুলাই আন্দোলন: গুজব, ষড়যন্ত্র আর দেশ বিক্রির কালো গল্প ফাঁস

5

মব ভায়োলেন্সে প্যারালাইজড দেশের গণমাধ্যম

6

কোটার জায়গায় কোটা রইল, মেধার হলো না জেতা

7

ডিএমপি কমিশনার ফের প্রমাণ করলেন, জঙ্গিদের মদদেই ক্ষমতায় ইউনূ

8

ইউনূসের প্রতিশ্রুতি ভাঙলেন খলিল; স্ত্রীকে ট্রাস্টি বানিয়ে ই

9

তবে কি আরেক পিলখানা হত্যাযজ্ঞ দেখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

10

জঙ্গিবাদীদের আবাধ দৌরাত্ম; রহস্যজনক প্রশাসনের নীরবতা

11

উপদেষ্টা আসিফের মদদে কুমিল্লায় হিন্দু নারী গণধর্ষণের শিকার!

12

মুদি দোকানে এক মাসের বিদ্যুৎ বিল সাড়ে ১৩ লাখ টাকা!

13

মব উস্কে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের চেষ্টায় ইউনূস গং

14

আসিফের ব্যাগ থেকে পাওয়া গেছে একে-৪৭ এর অ্যামোনেশন ম্যাগজিন

15

মব পেল বৈধতা, ইউনূসের নেতৃত্বে রক্তাক্ত বাংলাদেশ

16

চাইলাম কি আর পাইলাম কি—এই তো লাল স্বাধীনতা

17

কোটায় অস্ত্রের লাইসেন্স আসিফ মাহমুদের?

18

মৌসুমী, ফারিয়া ও সাবিলা নূরসহ ২৫ জনের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

19

যেভাবে দুর্নীতির মামলায় তারেক-গিয়াসকে খালাস দিল ইউনূস সরকার

20