নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট
সিলেটের পাথরসমৃদ্ধ কোয়ারি, নদী ও পাহাড়ি অঞ্চল এখন যেন বিএনপির লুটপাটের অভয়ারণ্য। প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনের আলোতে প্রকাশ্যেই চলছে পাথর উত্তোলন ও পাচার—এর নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা। বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়রা বলছেন, গত এক দশকে যতটা লুট হয়নি, শুধুমাত্র গত ১০ মাসেই তার কয়েক গুণ বেশি পাথর লুট হয়ে গেছে। আর এর পেছনে মূল হোতা বিএনপির নেতারা।
সরকার পতনের পরপরই নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপি: সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই সিলেটের কোয়ারিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো। তাদের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, শাবল, টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও নদীর বুক চিরে মাটি থেকে উত্তোলন করছে মূল্যবান পাথর। এই পাথর পরে মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দেশব্যাপী সরবরাহ করা হচ্ছে।
বড় বড় পাথরে ভরা ছিল পুরো এলাকা। ২০১৮ সালে
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ এলাকাতেই বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মী সক্রিয়ভাবে জড়িত। পাথর লুটপাটের মাধ্যমে তারা রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন, গড়ে তুলেছেন অবৈধ সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি নেটওয়ার্ক। এলাকার সাধারণ মানুষ ও পরিবেশকর্মীরা এতে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন।
প্রশাসন নিশ্চুপ, মামলার পরও গ্রেপ্তার নেই: সরকারি উদ্যোগে ইজারা বন্ধ থাকলেও বাস্তবে লুট বন্ধ হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, শুধু জাফলং এলাকায় গত ১০ মাসে পাথর লুটের ঘটনায় ৯টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ২২৬ জনকে। কিন্তু পুলিশ তাদের মধ্যে কাউকেই কার্যকরভাবে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অধিকাংশই জামিনে মুক্ত হয়ে আবার লুটপাটে লিপ্ত হয়েছেন।
ওইসব মামলার মধ্যে জড়িত রয়েছেন জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম, যিনি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও পরে জামিনে ছাড়া পান। জাফলং, ভোলাগঞ্জ, সাদা পাথর, শাহ আরেফিন টিলা—এসব জায়গায় লুটের অভিযোগ থাকলেও অধিকাংশ মামলাই আজও তদন্তাধীন।
পাথরের বদলে গর্ত আর ধু-ধু চর: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য খ্যাত সিলেটের নদ-নদী, পাহাড় ও পর্যটনকেন্দ্রগুলো এখন ধ্বংসের মুখে। কোয়ারি ও নদীতে পাথরের বদলে দেখা মিলছে ছোট-বড় গর্ত ও ধু–ধু চরের। সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর কেন্দ্র আজ প্রায় শ্রীহীন। সেখানকার পাথর লুটের কারণে "জল-পাথরের স্রোতোধারা" রূপ হারিয়েছে। হতাশ হয়ে ফিরছেন দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক।
পরিবেশবিদদের উদ্বেগ : বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, “গত ১৫ বছরে যা হয়নি, গত ১০ মাসে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লুট হয়েছে। বিএনপি নেতারা পরিকল্পিতভাবে প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে পুরো সিলেট অঞ্চলের পাথরশিল্পকে ধ্বংস করছে। সরকার ইজারা বন্ধ করল, কিন্তু লুট চলছেই — তাহলে লাভ কী?”
তিনি বলেন, “এই লুট বন্ধ না হলে শুধু পরিবেশ নয়, সিলেটের পর্যটন, প্রতিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।”
সমাধান কোথায়?: সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি অবিলম্বে কঠোর অভিযান, গণগ্রেপ্তার ও ইজারাব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার না হয়, তবে সিলেট অঞ্চলের প্রকৃতি, পরিবেশ ও পর্যটন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু মামলা করে দায় সারলে হবে না — প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং মাঠপর্যায়ে কঠোর নজরদারি।
মন্তব্য করুন