নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের ইতিহাসে একেকটি মাস ষড়যন্ত্রের নাম হয়ে উঠেছে—আগস্ট, নভেম্বর, আর এখন জুলাই। কিন্তু জুলাই কেবল একটি ষড়যন্ত্রের মাস নয়; এটি ছিল একবিংশ শতাব্দীর ‘সফট কুপ’-এর পাঠ্যবই। যেখানে গণআন্দোলনের ছায়ায় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বকে হঠানো হয়, সংবাদমাধ্যমকে নিরস্ত করা হয় এবং আন্তর্জাতিক প্রোপাগান্ডার সহায়তায় রচিত হয় এক ভুয়া গণহত্যার কাল্পনিক গাথা—যার লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় বৈধতাকে বিশ্বমঞ্চে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সেই জুলাই যেখানে গুজব ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশে শুরু হয় দাঙ্গা। আর এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল দেশ বিক্রি করে দেওয়া।
ষড়যন্ত্রের মাস জুলাই
শেখ হাসিনাকে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা থেকে সরানোর পেছনে অন্যতম ভূমিকা ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। এই সংগঠন থেকেই পরবর্তীতে তৈরি হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এরইমধ্যে এই দুটো সংগঠনের ষড়যন্ত্র ও গুজব ছড়ানোর বিষয়টি বুঝতে পেরে পদত্যাগ করেছেন অনেক নেতা-কর্মী। এই দুই সংগঠনের ভেতরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে একের পর এক নেতা-কর্মী পদত্যাগ করছেন।
সাম্প্রতিক সময়েই পদত্যাগ করেছেন সংগঠনটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি সংগঠনকে ‘ছলনা ও ভণ্ডামির জায়গা’ বলে অভিযোগ করেন। শুধু তিনিই নন, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শতাধিক নেতা পদত্যাগ করেছেন।
তারা বলছেন, এই সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট ও বিদেশি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্রে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মিথ্যা বিপ্লবের নামে সাধারণ ছাত্রদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই গণপদত্যাগ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়, বরং একটি আদর্শচ্যুত রাজনৈতিক প্রকল্পের পতনের আলামত। তারা বলছেন, শেখ হাসিনাকে সরিয়ে একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এসব সংগঠনের উত্থান হয়েছিল, যা এখন ভেঙে পড়ছে নিজের ভারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই গণপদত্যাগ কেবল অভ্যন্তরীণ অনিয়মের ফল নয়, বরং এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে সংগঠন দুটোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও আদর্শচ্যুতির সংকট রয়েছে। আন্দোলনের নামে ভণ্ডামি ও ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির কারণে শিক্ষিত তরুণরাও হতাশ হয়ে পড়ছেন। এক সময় যারা পরিবর্তনের আশায় এগিয়ে এসেছিল, তারা এখন নিজেই পরিবর্তন চায়।”
দেশ বিক্রির মাস জুলাই
রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত ও মানবিক সংকটের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডোর’ এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে চলছ বিতর্ক। সূত্র বলছে, জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ বিক্রির পরিকল্পনা করেছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস গং। শেখ হাসিনাকে উৎখাতের পর সেন্টমার্টিনে পর্যটক কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই বলেছিলেন, বাংলাদেশের একটা অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর চক্রান্ত চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ফিলিস্তিনের মতো বাংলাদেশের একটা অংশ চট্টগ্রাম, মিয়ানমার নিয়ে খ্রিস্টান স্টেট (রাষ্ট্র) বানাবে।
শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, বে অফ বেঙ্গলে (বঙ্গপোসাগরে) একটা ঘাঁটি করবে। তাঁর কারণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবসা বাণিজ্য চলে, আর এই জায়াগটাতে কোনো কন্ট্রোভার্সি নাই, কারও কোনো দ্বন্দ্ব নাই। বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের ভেতরেই একটি উপসাগর, এটা প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহার হচ্ছে। এই জায়গাটার ওপর অনেকের নজর।
ঢাকায় ৩ বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক অফিস চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুমোদন দেওয়া হয়। সূত্র বলছে, পূর্ব তিমুরকেও খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর আগে সেখানে কার্যালয় খোলে জাতিসংঘ। বাংলাদেশেও একই মডেলে আগানো হচ্ছে। আর সেটিই বাস্তবায়ন করছে ইউনূস গং। এ নিয়ে বিএনপি কিছু দিন মাঠে থাকলেও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানে সঙ্গে লন্ডনে ইউনূসের বৈঠকের পর দলটি আর মাঠে নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, তারেক রহমানকে ফাঁদে ফেলেছেন ইউনূস।
জুলাইয়ে দেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ উত্থান
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা তুমি কে? আমি কে? স্লোগান দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তিতে ফেলে। তখন অনেক শিক্ষার্থী না বুঝেই এই স্লোগানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনে নামে। পরে প্রমাণিত হয় এটি আসলে শিবিরের ষড়যন্ত্র। জুলাই আন্দোলনে অনেক সুশীলই প্রতিবাদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আগে থেকেই সক্রিয় ছিল।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদে নেমে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের শিক্ষকেরা। তারা শুধু বক্তব্য–বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, কর্মসূচিও পালন করছিলেন। তাদের ব্যানার ছিল ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক’। তবে এখন কোনো ধরনের অপরাধ ঘটলেও এসব সুশীলকে আর পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে একটি এনজিওকে ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার হয়েছে। এছাড়া ট্রাম্প আসার পরই বাংলাদেশে ইউএসএআইডির মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপরই কার্যত বন্ধ হয়ে কথিত সুশীলদের আন্দোলন।
শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতের সঙ্গে জড়িত ছিল জামায়াত ও নিষিদ্ধি ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীর। শেখ হাসিনার পতনের পরই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে ধর্মভিত্তিক সংগঠন হিযবুত তাহরীর। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সদস্য ইমতিয়াজ সেলিম জানান, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এই হিজবুত তাহরীর ও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী জুলকারনাইন তার ফেসবুক জানান, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। আর এই এজাজকে নিয়োগ দিয়েছিলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদই। এজাজ ছাত্র জীবনে ইসলামি ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, ২০০২ সাল থেকে হিজবুত তাহরীরের সাথে জড়িত হন।
সম্প্রতি বিমানবন্দরে আসিফের ব্যাগে একে-৪৭ এর অ্যামোনেশন পাওয়া যায়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আসিফ মাহমুদের ব্যাগে একে-৪৭-এর অ্যামোনেশন ম্যাগাজিন পাওয়া যাওয়াটা নিছক ‘ভুল’ হিসেবে দেখলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হালকাভাবে নেওয়া হবে। এটি শুধু একটি বিমানবন্দরে অস্ত্র বা ম্যাগাজিন বহনের প্রসঙ্গ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, রাজনৈতিক আন্দোলন, এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য পুনঃউত্থানেরও ইঙ্গিত বহন করে।
সম্প্রতি ‘উগ্র জঙ্গি আন্দোলনের’ সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে মালয়েশিয়ায় ৩৬ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মালয়েশিয়ার সরকার বলছে, বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের সঙ্গে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। এছাড়া পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায় লস্কর-ই-তৈয়বার ) শীর্ষ নেতা মুজাম্মিল হাজমি এক বিস্ফোরক দাবি করেছে— গত বছর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার পতনে লস্কর-ই-তৈয়বা ভূমিকা রেখেছে। এই বক্তব্য স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে আজ বাংলাদেশ একটি গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার।
ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের আস্ফলন
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন ঘটে যাওয়া হামলা, ধর্মীয় উগ্রতা ও সাংস্কৃতিক নিধনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজ ও বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে গঠিত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশ আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও উগ্রতার পুরস্কার
চট্টগ্রামে জামায়াত নেতার মুক্তির দাবিতে বাম ছাত্রজোটের এক কর্মসূচিতে এক নারীকে প্রকাশ্যে লাথি মারার ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অভিযুক্ত ব্যক্তি পরে জামিনে মুক্ত হয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা পান। একইভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগে আটক এক কর্মচারীকে জামিনের পর ‘তৌহিদী জনতা’ ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই প্রবণতা "উগ্রতার উৎসব"।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা
লালমনিরহাট-এ দুই হিন্দু নরসুন্দরকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে হেনস্তা করা হয়। পরিবার বলছে, মূলত আর্থিক বিরোধ থেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়া ও উগ্র সংগঠনের শোভাযাত্রা
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ২০৯ জন বন্দির পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং এর আগে নরসিংদীতে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ধরনের ব্যর্থতা বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। একই সময়ে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর ঢাকায় প্রকাশ্যে 'খেলাফত মার্চ' করে—যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগাম জেনেও থামাতে পারেনি।
সুফি মাজার ও সাংস্কৃতিক স্থাপনায় ধারাবাহিক হামলা
৫ আগস্ট থেকে শুরু করে তিন মাসে দেশে অন্তত ১০৫টির বেশি সুফি মাজার-এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হামলার শিকার হয় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন, জয়নুল আবেদিন গ্যালারির ভাস্কর্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কাচারি বাড়ি ও সিরাজগঞ্জের শশী লজের ভেনাস মূর্তি।
খেলাধুলা ও উৎসবেও রেষ
নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া, বসন্ত উৎসব ও বইমেলায় হামলার ঘটনা প্রমাণ করে উগ্রবাদ কেবল ধর্মীয় স্থানেই নয়, খেলাধুলা ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি পরিসরেও হানা দিচ্ছে। দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে ‘তৌহিদী জনতা’র হুমকিতে বন্ধ হয় একাধিক নারীদের ফুটবল ম্যাচ। সংঘর্ষও হয় আয়োজকদের সঙ্গে। এই দুটো ঘটনাতেই কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছিল স্থানীয় প্রশাসন।
মব সন্ত্রাস
রাজনৈতিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গণমাধ্যম নিপীড়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে 'মব' বা সংঘবদ্ধ জনতার উত্থান এখন নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও জননির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘মব’-কে ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে কার্যত তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
২৬ জুন রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সেমিনারে প্রেস সচিব বলেন, “বলা হচ্ছে মব তৈরি হচ্ছে, আমি এটাকে মব বলছি না, বলছি প্রেসার গ্রুপ। সেটা তৈরি হচ্ছে সাংবাদিকতার ব্যর্থতার কারণে।
তিনি অভিযোগ করেন, ১৫ বছরের সরকারে থাকা অবস্থায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ এবং রাষ্ট্রীয় হিংস্রতা জন্ম দিয়েছে বর্তমান ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। এর মধ্যে এক ধরনের জনরোষ জমে উঠে মব হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে।
মব সহিংসতা ও রক্তাক্ত পরিণতি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সৃষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশজুড়ে সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০২৪–২৫ সালে মব-সংশ্লিষ্ট সংঘাতে শতাধিক মানুষ নিহত হন। সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানে হামলা, যেমন—বঙ্গবন্ধু ভবন (ধানমন্ডি ৩২), রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি, সুফি মাজার ইত্যাদিতে আঘাত আদর্শিক সন্ত্রাসের আলামত বহন করে।
বিশেষত, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার বাসায় জনতার হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্ন তুলেছে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে।
গণমাধ্যম ও দলীয় সূত্র অনুযায়ী, গত এক বছরে অন্তত ২৬ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী পুলিশি হেফাজতে, কারাগারে কিংবা অভিযানের সময় নিহত হয়েছেন। এসব মামলার অধিকাংশই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত বলে দাবি করেছে পরিবার ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
এছাড়া মব তৈরি করে শত শত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। যেগুলোর অনেককিছুই গণমাধ্যমে আসছে না।
গত সেপ্টেম্বরে শিশুর জন্য ওষুধ কিনতে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নগরীর বিনোদপুর এলাকায় গেলে হামলা হয় আব্দুল্লাহ আল মাসুদের ওপর। হামলায় তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর দেখে সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তিনি মারা যান। সম্প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জেরে মাগুরায় জ্যান্ত কবর দেওয়া কমিরুল মোল্যা নামের এক ব্যক্তিকে। এ ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এর আগে শেরপুরে ছাত্রলীগ নেতা শাকিলের ওপর ছাত্রদল ক্যাডারদের নির্মম হামলায় তার পা কেটে নেওয়া হয়। ২৮ জুন পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নে পারিবারিক বিরোধের জেরে ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শহিদুল ইসলাম হাওলাদার ও তাঁর ভাবি মৌকলি বেগম (৪৮) কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় শহিদুল ইসলামের স্ত্রী রেহানা বেগমকেও (৪০) কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে।
গত মার্চে পাবনার সাঁথিয়ায় এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধে আমিরুল ইসলাম (৫০) নামের যুবলীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে মাগুরায় সদর উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে ধানক্ষেতে সার দিতে যাওয়ার সময় প্রতিপক্ষ দলের হামলায় জাহিদ জোয়ারদার (৫০) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী খুন হন। গত জানুয়ারিতে পুলিশ পরিচয়ে দিয়ে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের চানপাড়া গ্রামে কাওসার লষ্কর (৫৫) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
সাম্প্রতিক এক সভায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “সংঘবদ্ধ জনতার নামে সহিংসতা আর সহ্য করা হবে না।” তিনি সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কথা জানান।
অন্যদিকে, বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, “মব জাস্টিস এখন এক হিংস্র উন্মাদনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মানবতা ধ্বংস করছে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলীয় নেতা হাসনাত আবদুল্লাহও বলেন, “মব নয়, এটা জনরোষ। যারা বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তাদের বিচার না হওয়াতেই এই ক্ষোভ।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই মব আন্দোলন আসলে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতা ও ন্যায়বিচারের অভাবের ফল। সরকার মবকে বৈধতা দিচ্ছে—এটি ভয়ংকর ইঙ্গিত।”
তারা সতর্ক করে দেন, যদি ন্যায়ের অভাব এবং বিচারহীনতা অব্যাহত থাকে, তাহলে ‘মব’ আরও রক্তাক্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে দেশকে।
জুলাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার মাস
সম্প্রতি ঢাকার বিজয় সরণিতে ৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানের দিন ভেঙে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়’ এর আশপাশের স্থাপনাও ভেঙে ফেলা হল, সেই জায়গায় হবে জুলাই শহীদদের স্মরণে ‘গণমিনার’।
আসছে জুলাইয়ে নতুন ভাস্কর্য তৈরির কাজ শুরু হবে। সেজন্য প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
এর আগে ২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তক আপডেট – জাতীয় নোটসহ শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে; শেখ মুজিবুর রহমানের “জাতির পিতা” উপাধি বাদ পড়েছে; ভারতের ভূমিকা ও শেখ হাসিবের দূতাবাস বা বক্তৃতা সংরক্ষিত ছবি ও তথ্য কমিয়ে আনা হয়েছে। নতুন বইগুলোতে ২০২৪–২৫ এর ছাত্র–ছাত্রীদের বিদ্রোহ ও তাতে নিহত কয়েকজনের বর্ণনা যোগ করা হয়েছে; একই সঙ্গে ১৯৭১–এর স্বাধীনতার প্র ঘোষণা সম্পর্কে শেখ মুজিবার ভূমিকা খর্ব করে, এবং তা প্রায় সম্পূর্ণ তুলে ফেলা বা জিয়াুর রহমানকে কেন্দ্র করে উপস্থাপন করা হয়েছে ।
ভারতের অবদান বাদ – ১৯৭১–এর ভারতীয় সামরিক সহায়তা, শেখ মুজিব–পেট্র ডে-সহ বিভিন্ন তথ্যও সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।
‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞা পরিবর্তন (অ্যামেন্ডমেন্ট ২০২৫) – এবার শুধু যেসব ব্যক্তি সরাসরি প্রশিক্ষণ বা যুদ্ধকার্যে লিপ্ত ছিলেন, তাদের ‘বীর’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে; সিভিলিয়ান, তৎকালীন সাংবাদিক, শিল্পী, রেডিও বা রেডিঅথিতিসহ বিপুল অংশকে ‘সহযোগী’ হিসেবে নামিয়ে আনা হচ্ছে, যার ফলে ঐতিহাসিক অবদানের মূল্য কমে যাচ্ছে । এই পরিবর্তনকে অসংবিধানিক ও অবহেলার নামাঙ্কিত করেছেন; তারা বলেছেন—“শ্রদ্ধা কমে যায় না বলে সরকার দাবি করছে, কিন্তু পদবির অপসারণই সম্মানহানি”।
বাংলাদেশের ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১–এর পাকিস্তানি সহযোগীর নামে হলের নামকরণ করে ইতিহাস বিকৃতিকারীদের ভূমিকা খণ্ডন করেছে । এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নষ্ট হয়েছে, ধানমন্ডি ৩২ ধ্বংস করা হয়েছে।
পুলিশ হত্যার মাস জুলাই
এ মাসে কথিত ছাত্র আন্দোলনে শত শত পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘিরে গত রোববার (৪ আগস্ট) দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ঢুকে ১৩ পুলিশ সদস্যকে বিভৎসভাবে পিটিয়ে মারা হয়। এছাড়া যাত্রাবাড়ী, উত্তরসহ রাজধানী ও এর বাইরে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, “জুলাই” মাস কেবল একটি ষড়যন্ত্রের সময় নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শ, নিরাপত্তা ও জাতীয় সত্তার গভীর সঙ্কটের সময় হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এ থেকে উত্তোরণে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। নয়তো ইতিহাসের ‘জুলাই’ বারবার ফিরে আসবে, হয়তো আরও ভয়ঙ্কর রূপে।
মন্তব্য করুন