নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন ঘটে যাওয়া হামলা, ধর্মীয় উগ্রতা ও সাংস্কৃতিক নিধনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজ ও বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে গঠিত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশ আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও উগ্রতার পুরস্কার : চট্টগ্রামে জামায়াত নেতার মুক্তির দাবিতে বাম ছাত্রজোটের এক কর্মসূচিতে এক নারীকে প্রকাশ্যে লাথি মারার ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অভিযুক্ত ব্যক্তি পরে জামিনে মুক্ত হয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা পান। একইভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগে আটক এক কর্মচারীকে জামিনের পর ‘তৌহিদী জনতা’ ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই প্রবণতা "উগ্রতার উৎসব"।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা : লালমনিরহাট-এ দুই হিন্দু নরসুন্দরকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে হেনস্তা করা হয়। পরিবার বলছে, মূলত আর্থিক বিরোধ থেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়া ও উগ্র সংগঠনের শোভাযাত্রা: কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ২০৯ জন বন্দির পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং এর আগে নরসিংদীতে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ধরনের ব্যর্থতা বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। একই সময়ে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর ঢাকায় প্রকাশ্যে 'খেলাফত মার্চ' করে—যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগাম জেনেও থামাতে পারেনি।
সুফি মাজার ও সাংস্কৃতিক স্থাপনায় ধারাবাহিক হামলা: ৫ আগস্ট থেকে শুরু করে তিন মাসে দেশে অন্তত ১০৫টির বেশি সুফি মাজার-এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হামলার শিকার হয় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন, জয়নুল আবেদিন গ্যালারির ভাস্কর্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কাচারি বাড়ি ও সিরাজগঞ্জের শশী লজের ভেনাস মূর্তি।
খেলাধুলা ও উৎসবেও রেষ: নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া, বসন্ত উৎসব ও বইমেলায় হামলার ঘটনা প্রমাণ করে উগ্রবাদ কেবল ধর্মীয় স্থানেই নয়, খেলাধুলা ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি পরিসরেও হানা দিচ্ছে। দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে ‘তৌহিদী জনতা’র হুমকিতে বন্ধ হয় একাধিক নারীদের ফুটবল ম্যাচ। সংঘর্ষও হয় আয়োজকদের সঙ্গে। এই দুটো ঘটনাতেই কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছিল স্থানীয় প্রশাসন।
সরকারের দায় সারা প্রতিক্রিয়া: এই সংকটের মধ্যেও আন্তর্জাতিক মহল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নীরব। এমনকি ইউনেস্কো থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। ১ এপ্রিল প্রকাশিত দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদন বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলার পরও অন্তর্বর্তী সরকার তা 'মিসলিডিং' বলে উড়িয়ে দেয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “দেশে কোনো ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি”। তথ্যমন্ত্রী মাহফুজ আলমও বলেন, “চরমপন্থার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।” কিন্তু বাস্তব চিত্র এই বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মত বিশ্লেষকদের।
জাতির আত্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “এই সরকারের সময়ে তিনটি বিষয় স্পষ্ট—মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা, নারীবিদ্বেষ ও ডানপন্থার উত্থান।” বিশ্লেষকেরা একে 'জাতির আত্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
গণযোগাযোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, “নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বিভ্রান্তিকর কিছু পাইনি। বরং সরকারের প্রতিক্রিয়া সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়।”
নাগরিক সমাজের আহ্বান: সাংবাদিক, গবেষক ও নাগরিক সংগঠনগুলো বলছে, এই পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকা মানে ইতিহাসের অপরাধে অংশীদার হওয়া।বাংলাদেশের বহুত্ববাদ, ধর্মীয় সহনশীলতা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষায় এখনই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিচ্ছেন তারা।
মন্তব্য করুন