আরাফাত মুনতাসির
বাংলাদেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে—এই কথাটি সম্প্রতি অনেকবার বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার এই বক্তব্য অনেকের কানে কাঁটাচেরা শোনালেও, বাস্তবতা যেন দিন দিন তাকে সঠিকই প্রমাণ করছে। দেশজুড়ে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ, নিপীড়নমূলক নীতির ব্যবহার, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নতুন উত্থান এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের ধরন বিবেচনায় আজ অনেকেই বলতে বাধ্য হচ্ছেন— হ্যাঁ, আমরা এক অঘোষিত যুদ্ধাবস্থায় আছি।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাস থেকেই দেশের ভেতরে এক অদৃশ্য অথচ সুপরিকল্পিত যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ কোনো বাহ্যিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের আত্মা, ইতিহাস ও পরিচয়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক প্রলম্বিত সংঘাত। যার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায় ৫ আগস্ট থেকে, যেদিন থেকে জাতি প্রত্যক্ষ করছে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রসমর্থিত শক্তির হাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপুষ্ট নাগরিক সমাজের ওপর এক অসীম নিপীড়নের শুরু।
এ যুদ্ধের রণনীতির মধ্যে আছে মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের গুম ও খুন, ধর্ষণ-গণধর্ষণ, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, এবং সবচেয়ে ভয়াবহভাবে—স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক ও চেতনার ওপর সুপরিকল্পিত হামলা।
এই যুদ্ধ যে নিছক দমন-পীড়নের গণ্ডিতে আটকে নেই, তার প্রমাণ মেলে প্রতিটি হামলার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেমন টার্গেট করেছিল হিন্দু, বাঙালি, ও আওয়ামী লীগ-সমর্থকদের, আজও তেমন টার্গেট হচ্ছে ঠিক ঐ চেতনার উত্তরসূরিরা।মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী তরুণ-তরুণী, রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যমকর্মী— কেউই রেহাই পাচ্ছেন না।
এই পরিস্থিতিকে অনেকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলছেন এবং তা অমূলক নয়। পরিকল্পিতভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, আদিবাসী ও সনাতনী সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা, এবং ভোটাধিকার হরণ—এসবই একটি জাতিকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অস্তিত্বগতভাবে নিঃশেষ করার কৌশল। ঠিক যেমন ১৯৭১-এ হয়েছিল।
এই অঘোষিত যুদ্ধের পেছনে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ইউনূসপন্থী গোষ্ঠীকে ঘিরে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অভিযোগ উঠছে, এই গোষ্ঠী আমেরিকান ডিপ স্টেট-এর আর্থিক মদদে ও পাকিস্তানের সক্রিয় প্ররোচনায় বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। এদের অন্যতম কৌশল হলো—মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে পুনরায় রাজনীতির মঞ্চে প্রতিষ্ঠা করা এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়ে এক জাতিবিরোধী শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
এই গোষ্ঠীর সহযোদ্ধা হিসেবে উঠে আসছে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য, জঙ্গিগোষ্ঠী, বিএনপির যুদ্ধাপরাধী অংশ এবং ইউনূসের আশীর্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম এনসিপি-এর নাম।
এই অঘোষিত যুদ্ধের অন্যতম উদ্বেগজনক দিক হলো জাতীয় স্মারক এবং বাঙালির পরিচয়ের ওপর আক্রমণ। একদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে, অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তক ও সাংস্কৃতিক উপাদান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চলছে।
এ যেন এক রিসেট বাটন চাপা, যার মাধ্যমে পুরো জাতিকে 'পরিচয়হীন' করে তোলা হচ্ছে। এটি শুধুই ইতিহাস মুছে ফেলার চক্রান্ত নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিশাহীন করে তোলার এক সুদূরপ্রসারী স্ট্র্যাটেজি।
এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের নয়, এটা আদর্শের। যারা ইতিহাসকে মুছে দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে ইতিহাসের আলোকবর্তিকা হাতে। এই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত—তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কেউ যদি বেঁচে না থাকে, তবুও প্রতীকী বিচার হতে হবে। যাতে ইতিহাস বুঝে—বাংলাদেশের জাতিসত্তার ওপর আঘাত করলে তার মূল্য কেবল রাজনৈতিক নয়, চিরন্তন শাস্তিতে গেঁথে থাকবে।
শুধু প্রতিশোধ নয়, চাই প্রতিরোধ—গণতান্ত্রিক উপায়ে, আইনের আওতায়, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করে। চাই এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ কোনো ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের ওপর এমন যুদ্ধ চাপিয়ে দেবার সাহস না পায়।
আমরা ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। ১৯৭১ সালে যেমন করে গোটা জাতি একত্রিত হয়েছিল বিদেশি হানাদার আর দেশি দোসরের বিরুদ্ধে, আজও প্রয়োজন তেমনই একটি ঐক্য। এই যুদ্ধ বাস্তব, যদিও অনেকে তা মানতে চায় না। কিন্তু যতদিন না আমরা এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে মোকাবেলা করবো, ততদিন জাতি থাকবে অস্তিত্ব সংকটে।
বাংলাদেশ আবারো জাগুক। ইতিহাস যেন আবার সাহসী হয়—যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে, ও চেতনাহীনতার বিরুদ্ধে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
মন্তব্য করুন