নিজস্ব প্রতিবেদক
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি এক ৩৫ মিনিটের ভিডিও প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে এই প্রতিবেদনকে পক্ষপাতদুষ্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
প্রতিবেদনের মূল ভিত্তি একটি মাত্র ১৮ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপ, যার প্রেক্ষাপট কিংবা প্রাপক স্পষ্ট নয়। এমনকি এই ক্লিপের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, যে প্রতিষ্ঠান এটি যাচাই করেছে, তারাও নিশ্চিতভাবে ক্লিপটিকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেয়নি—শুধুমাত্র "সম্ভবত কৃত্রিম নয়" বলে মত দিয়েছে।
প্রতিবেদনে ব্রিটিশ প্রসিকিউটর টবি কেডম্যানের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা হলেও, তার অতীতে যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল জামায়াতের পক্ষে কাজ করার ইতিহাস গোপন রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণকে খণ্ডিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং আন্দোলনের সময়কার সহিংসতা, পুলিশ হত্যা, ভাঙচুরসহ অন্যান্য প্রেক্ষাপট উপেক্ষিত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রতিবেদন এমন এক সময় প্রকাশ করা হয়েছে, যখন দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আইন-শৃঙ্খলাজনিত চরম সংকট চলছে। দুই দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা দেশীয় রপ্তানি খাতে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ সারাদেশে খুন, ধর্ষণ, গণপিটুনি ও সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে ৬৭ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৭৬ নারী ও শিশু, যার মধ্যে ২৯২ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে দেশে ১ হাজার ২৪৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৯ হাজার ১০০টি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব পরিসংখ্যান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল না হলে অনেক অপরাধে পুলিশ কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণা ও ইউনূস সরকারের প্রতিক্রিয়া
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৭ জুলাই তার সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ ঘোষণা দেন, ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। ৩৫% শুল্কের ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, ফলে চাহিদা কমবে। বিদেশি ক্রেতারা তখন বিকল্প বাজার—যেমন কেনিয়া, মিশর বা হন্ডুরাস—খুঁজে নিতে পারেন।
বিজিএমইএ-এর সাবেক পরিচালক মো. মহিউদ্দিন বলেন, “বিদেশি ক্রেতারা মূলত সস্তা দামের জন্য বাংলাদেশে আসেন। শুল্কের কারণে যদি খরচ বাড়ে, তাহলে তারা অন্য কোথাও চলে যাবেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ৩৫% শুল্ক আরোপের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এটা স্পষ্ট যে, দেশের অর্থনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ইউনূস সরকার এই প্রতিবেদনকে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এছাড়া মানবাধিকার পরিস্থিতি যতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা এখন আর শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার বিষয় না—এটা সরকারের নেতৃত্বের সঙ্কট। এটি স্পষ্ট যে, প্রতিবেদনটি সামাজিক মাধ্যমে সরকারবিরোধী আবেগ উসকে দিতে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু জনমনে এখন যথেষ্ট সচেতনতা রয়েছে। তারা জানে, আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে কখন, কীভাবে এবং কেন ব্যবহার করা হয়।
মন্তব্য করুন