বিশেষ প্রতিবেদন
ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে ও জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া বর্ণনা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভিডিও প্রমাণে দেখা যাচ্ছে, নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগে দীপু পুলিশের হেফাজতেই ছিলেন, ভালুকা থানার অফিসার ইনচার্জের কক্ষের ভেতরে।
১৯ ডিসেম্বরের ওই নৃশংস ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব দাবি করেছিল যে উত্তেজিত জনতা দীপুকে একটি পোশাক কারখানা থেকে ছিনিয়ে নেয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজ ভিন্ন বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভিডিওতে দেখা যায়, নীল শার্ট পরিহিত দীপু ভালুকা থানার ওসি হুমায়ুন কবিরের কক্ষে বসে পুলিশের সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন এবং নিরাপত্তা চাইছেন। একই সময় থানার বাইরে উত্তেজিত জনতা তার শাস্তির দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিল।
‘নর্থইস্ট নিউজ’-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, র্যাব-১৪ ঘটনার তদন্তভার নেওয়ার আগেই এই ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। ফুটেজে স্পষ্ট বোঝা যায়, কারখানা থেকে নয়, দীপু থানাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের সুরক্ষায় থাকা একজন ব্যক্তি কীভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই জনতার হাতে চলে গেলেন, অথবা পুলিশ তাকে জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল কি না।
২০ ডিসেম্বর র্যাব-১৪–এর পরিচালক নাইমুল হাসান এবং ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম জানান, ‘ফিনিক্স নিটিং লিমিটেড’ নামের কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দীপুকে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেয়। এরপর জনতা তাকে টেনেহিঁচড়ে ভালুকা স্কয়ারে নিয়ে গিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় কারখানার মালিকসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে ভিডিও প্রমাণ সেই বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ভিডিও অনুযায়ী, কারখানায় মারধরের শিকার হয়ে দীপু কোনোমতে পালিয়ে থানায় পৌঁছান এবং পুলিশের আশ্রয় চান। সেখান থেকে কীভাবে তিনি জনতার হাতে পড়লেন, সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। এ বিষয়ে ওসি হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে আরও বিস্তৃত সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা। ১৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মারা যান উগ্রবাদী সংগঠন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদী, যার প্রকৃত নাম ওসমান গনি। এর আগে ১২ ডিসেম্বর, যেদিন নির্বাচন কমিশন ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে, সেদিন ঢাকার পুরানা পল্টনে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা গনিকে খুব কাছ থেকে গুলি করে।
গনির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা তৈরি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ভালুকায় দীপু চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়। প্রথমে কারখানার ভেতরে তাকে মারধর করা হয়। পরে তিনি থানায় পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি। অভিযোগ রয়েছে, যখন তাকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল তখনো তার শরীরে প্রাণ ছিল এবং জনতা উল্লাস করছিল।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ওসমান গনির হত্যাকারীরা ভারতে পালিয়ে গেছে। তবে দীপু চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ড, থানার ভেতরে তার উপস্থিতির ভিডিও প্রমাণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরবর্তী বক্তব্যের মধ্যে যে বড় ধরনের অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে, তা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয় বরং সংখ্যালঘু নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ নিয়েও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
মন্তব্য করুন