নিজস্ব প্রতিবেদক
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ দায়ের করা সত্ত্বেও কোনো কার্যকর সমাধান বা প্রতিকার না পাওয়ায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে হতাশা ক্রমশ বাড়ছে।
রাজধানীতেই একাধিক ভয়াবহ ঘটনা
রাজধানীর পুরান ঢাকায় সম্প্রতি চাঁদা না দেওয়ায় এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের পরিবার জানায়, মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল স্থানীয় বিএনপি-সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না দেওয়ায় তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একইদিনে রাজধানীর পল্লবীর আলব্দিরটেক এলাকায় ‘এ কে বিল্ডার্স’ নামের একটি আবাসন কোম্পানিতে হামলা চালিয়ে গুলি করে বিএনপি সন্ত্রাসীরা। এতে আহত হন কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম।
এছাড়া রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ‘শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস’ নামের একটি পরিবহন সংস্থার বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে যুবদলের সাবেক এক নেতার বিরুদ্ধে। দাবি—৫০ লাখ টাকা চাঁদা।
সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা ও চাঁদাবাজি
চাঁদাবাজির ঘটনা শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নয়। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ব্যবসায়ী সানজিদকে মারধর, লুটপাট এবং তার বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে বিএনপি-সম্পৃক্ত জব্বার ও তার অনুসারীদের হাতে। নাটোর, নেত্রকোনা, গাজীপুর, বরিশাল, কুড়িগ্রাম, পাবনা, ফেনী, চট্টগ্রাম, নরসিংদীসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে এসেছে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের বিরুদ্ধে।
এক নজরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের চক দৌলতপুর এলাকায় চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় এক ব্যবসায়ীকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। এ সময় ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়। এছাড়া তিনটি মোটরসাকেল ভাংচুর ও একটি মাইক্রোবাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
স্থানীয়রা জানান, চক দৌলতপুর এলাকার সাদমান আলীর ছেলে ব্যবসায়ী সানজিদের কাছ থেকে বেশ কিছুদিন ধরে চাঁদা চেয়ে আসছিল একই এলাকার আকবর আলীর ছেলে জব্বার ও তার লোকজন। জব্বার বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত।
ওপরের যেসব ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে এগুলো মাত্র চার পাঁচ দিন আগের ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগের বিভিন্ন খবর উঠে এসেছে৷
গত ৬ জুলাই চাঁদাবাজি মামলায় গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হাসান স্বপনকে (জিএস স্বপন) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ১২ জুন নেত্রকোনায় কেন্দুয়ায় যানবাহনে চাঁদাবাজির অভিযোগে যৌথবাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন বিএনপি নেতাসহ তিনজন।
গত ১২ মে নাটোরের সিংড়ায় চাঁদাবাজির অভিযোগে এক বিএনপি কর্মীকে আটক করে যৌথবাহিনী । গত ১০ মার্চ পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট এলাকায় এমটিসি টাওয়ার নামের বিপণিবিতানের দখল নিয়ে যুবদলের দুই গ্রুপের সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ছয়জন আহত হন। ৮ মার্চ ঢাকা কলেজের সামনে ফুটপাতের ব্যবসা দখল নিয়ে হকারদের মারধোর করার অভিযোগ ওঠে ঢাকা কলেজ ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ‘বন্ধন পরিবহন' বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ৷ এতে কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি ও সবজি মার্কেট দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন। যারা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন তারা স্থানীয় শ্রমিক দলের সদস্য বলে অভিযোগ। ১২ মে দলের নামে অফিস খুলে চাঁদাবাজির অভিযোগে নাটোরের সিংড়া থেকে পুলিশ আটক করে স্থানীয় বিএনপি নেতা হাজী কুদ্দুস আখন্দকে। তিনি উপজেলা মৎসজীবী দলের সাবেক সভাপতি।
২৮ মে কুঁড়িগ্রাম সদর উপজেলায় গরুর হাটে চাঁদবাজির অভিযোগে আটক হন বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দুই নেতা। ২৯ এপ্রিল নাটোরে ধানের ট্রাকে চাঁদাবাজির অভিযোগ আটক হন বিএনপি ও যুবদলের তিন নেতা। ১৩ এপ্রিল পাবনার ইশ্বরদীতে অটোরিকশার স্ট্যান্ড দখল নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার এমসি বাজারে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম মাইকে ঘোষণা দিয়ে বাজার দখল করে চাঁদা দেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণার ভিডিও ভাইরাল হলে তাকে যুবদল থেকে বহিস্কার করা হয়। ১১ আগস্ট বরিশাল শহরে তিনটি সরকারি পুকুর দখল করে তা বালু দিয়ে ভরাট করার উদ্যোগের অভিযোগে বিএনপির বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের দলীয় সদস্যপদ স্থগিত হয়।
চাঁদাবাজিতে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও
শেখ হাসিনাকে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা থেকে সরানোর পেছনে অন্যতম ভূমিকা ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। এই সংগঠন থেকেই পরবর্তীতে তৈরি হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এরইমধ্যে এই দুটো সংগঠনকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট তকমা দিয়ে পদত্যাগ করেছেন অনেক নেতা-কর্মী।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্ম থেকে পদত্যাগ করেছেন সংগঠনটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বলেন, 'প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে যাওয়ার পরেই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্ররাই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সবার সাথে শুধু ছলনা হয়েছে।'
গত জুনে সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মব সৃষ্টির অভিযোগ তুলে বরিশালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠকসহ তিনজন পদত্যাগ করেছেন। ১ জুন রাতে বরিশাল রিপোর্টাস ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এই তিনজন।
গত মে মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটি থেকে এক নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া ওই নেতার নাম আবদুল হাফিজ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শাখার কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার বড় হাতিয়া ইউনিয়নের রশিদার ঘোণা এলাকায়।
গত মে মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটির শীর্ষ ১৬ নেতা পদত্যাগ করেছেন। সংগঠনটির কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে তারা দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে এই পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
বৈষম্যবিরোধী-এনসিপির সঙ্গে সমান তালে চাঁদাবাজি করছে জামায়াতও
গত ৩০ জুন জামায়াত কর্মী পরিচয়ে মামলা বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে মেহেদী হাসান তুষার নামের এক জামায়াত কর্মীর বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মামলা থেকে নাম বাদ দিতে ফেনী সদর মডেল থানার ওসির নাম ভাঙ্গিয়ে এক শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাদী হয়ে জামায়াত নেতা ও তার ভাইকে আসামি করে মামলাটি করেন।
এর আগেই ওইদিন সন্ধ্যায় চাঁদা সংক্রান্ত একটি অডিও ফাঁসের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামী ফেনী জেলা কমিটির পক্ষ থেকে ওই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃত নেতার নাম জাকির হোসেন। তিনি জেলা জামায়াতে ইসলামীর রোকন এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন ফেনী পৌর শাখার সাবেক সহকারি সেক্রেটারি ছিলেন।
নদী ও খাল থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন, ইটভাটা, পাহাড় কাটাসহ নানা খাতে চাঁদাবাজি চলছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের দাপটে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। গত ৫ আগস্টের পর থেকে এই এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে জামায়াতের ‘ত্যাগী কর্মীরা’।
দৈনিক সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি ইউনিয়নে তাদের দাপট। সাংগঠনিকভাবে পদে না থাকলেও তাদের পরিচয় দলের কর্মী। তারা নিজেদের সাবেক সংসদ সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব। সাতকানিয়ার তিন ইউনিয়নে তিনটি ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ তৎপর। তাদের নেতা নেজাম উদ্দিন গণপিটুনিতে নিহত হন। তবে জামায়াতে ইসলামীর দাবি, তারা কর্মীদের কোনো অপরাধকে প্রশ্রয় দেয় না। পুলিশের দাবি, অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
চলতি বছরের এপ্রিলে নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদীতে ঈদের আগে চাঁদা (এয়ানত) না পেয়ে ইসলামী ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে সড়কে ফেলে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার সহকর্মীদের দাবি, হামলাকারীরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের স্থানীয় কর্মী এবং স্থানীয় এক জামায়াত নেতার অনুসারী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা ও জনঅসন্তোষ
এই ধারাবাহিক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ এবং ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বহুবার অভিযোগ জানালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ নির্লিপ্ত থেকেছে, আবার কোথাও কোথাও অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নিতেও দেখা গেছে বিলম্ব।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় পরিচালিত এই চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তা দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা, অর্থনীতি ও আইনের শাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক শূন্যতায় অপরাধীরা চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি এই অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা—আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক, আর এসব রাজনৈতিক নামধারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
মন্তব্য করুন