স্টাফ রিপোর্টার
দেশে চলমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও ৫ আগস্টের সরকার পতনের সময় থানাসহ বিভিন্ন পুলিশ স্থাপনা থেকে লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলির বড় অংশ এখনও উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ধারাবাহিক অভিযান চালালেও চাইনিজ রাইফেল, চাইনিজ এসএমজি ও পিস্তলসহ প্রায় ১ হাজার ৩৪৩টি অস্ত্র এবং প্রায় আড়াই লাখ রাউন্ড গুলি এখনও উদ্ধার হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
পুলিশ স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ, অস্ত্র উদ্ধার এখনো অসম্পূর্ণ:
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আন্দোলনে দেশের ৪৬০টি পুলিশ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ১১৪টি থানাতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে এবং ১,০২৪টি যানবাহন ধ্বংস হয়। সেই সময় মোট ৫,৭৫৬টি অস্ত্র লুট হয়, যার মধ্যে উদ্ধার করা গেছে ৪,৪১৩টি। এখনও ১,৩৪৩টি অস্ত্র এবং ৬,৫২,০৮২ রাউন্ডের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ গুলি উদ্ধার হয়নি। প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাইনিজ রাইফেল, পিস্তল ও কিছু চাইনিজ এসএমজি এখনও বাইরে রয়েছে; যদিও সি-ক্যাটাগরির সব এসএমজি উদ্ধার করা গেছে।
কারাগার থেকে বন্দি পলায়ন ও লুট হওয়া অস্ত্র বিক্রি:
নরসিংদী, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, শেরপুর ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে ২,২৪৭ জন বন্দি পালিয়ে যায়, এবং ৬৭টি অস্ত্র লুট হয়; এর মধ্যে মাত্র ২৭টি উদ্ধার করা গেছে। পালানো বন্দিদের মধ্যে ৯৩ জন ছিলেন ‘বিশেষ প্রকৃতির’ আসামি এদের ৬০ জন গ্রেপ্তার হলেও বাকিরা এখনও পলাতক।
অভিযোগ উঠেছে, লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি দেশের ভেতরে বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অভিযানে পুলিশের লুট হওয়া রিভলবার ও চাইনিজ রাইফেলের গুলি উদ্ধার হয়েছে। আটক ব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন, তারা এসব গুলি বিক্রির কাজে জড়িত ছিলেন।
সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশে উদ্বেগ:
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, দেশের সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। নিয়মিত অভিযানে দেশীয় পিস্তল, ম্যাগাজিন ও গুলি উদ্ধার করা হলেও সীমান্তের দুর্বল নজরদারির কারণে নতুন অস্ত্র ঢোকার ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ ও লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে থাকায় নির্বাচনকালীন সময়ে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
অস্ত্র জমা ও পুরস্কার কার্যক্রমে ফলহীনতা:
অন্তর্বর্তী সরকার অস্ত্র উদ্ধারে উৎসাহ দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। শর্টগান বা পিস্তল উদ্ধারে ৫০ হাজার, চাইনিজ রাইফেল বা এসএমজির ক্ষেত্রে ১ লাখ এবং এলএমজির জন্য ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তবে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও গোয়েন্দা তথ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে এই পুরস্কার কার্যক্রম প্রত্যাশিত সাড়া পায়নি। দেশের বিভিন্ন থানায় জমা পড়েছে প্রায় ৯,১৯১টি বৈধ অস্ত্র, কিন্তু ১,৬৫৪টি লাইসেন্সধারী অস্ত্র জমা পড়েনি, যা এখন অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের কঠোর সমালোচনা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও অপরাধবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “লুট হওয়া অস্ত্রগুলো যদি অপরাধীদের হাতে থেকেই যায়, তবে নির্বাচনের সময় তা বড় ধরনের সহিংসতার কারণ হতে পারে। এখনই প্রযুক্তি, গোয়েন্দা তথ্য ও সমন্বিত অভিযান জোরদার করা জরুরি।”
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় চরম ব্যর্থতা:
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নিরাপত্তা কাঠামোর সমন্বয়হীনতা ও দেরি করা অভিযান দেশের জনগণের আস্থাকে দুর্বল করছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার না হওয়া শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারা আশ্বাস দিলেও, বাস্তবে মাঠপর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেনি। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এই অব্যবস্থা পুরো দেশকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
মন্তব্য করুন