অনলাইন ডেস্ক
চীনের বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা এখন সংকটে পড়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনা সামরিক সরঞ্জাম বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। পাকিস্তান বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা রপ্তানিকারক গ্রাহক। দেশটি ভারতের সঙ্গে আকাশ, স্থল ও নৌবাহিনী—সবক্ষেত্রেই অপারেশনাল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
এই ব্যর্থতাগুলো চীনের সামরিক শিল্প কাঠামোর মৌলিক দুর্বলতাগুলোকে সামনে এনে দিয়েছে, যা পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহকারীদের স্থান দখলের চীনের কৌশলগত লক্ষ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। চীন নিজেকে পশ্চিমা প্রতিরক্ষা সরবরাহকারীদের সস্তা বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেছিল এবং ২০২০-২০২৪ সময়কালে তাদের মোট অস্ত্র রপ্তানির ৬৩% পাকিস্তানে বিক্রির মাধ্যমে অর্জন করে। একক গ্রাহকের ওপর এত বেশি নির্ভরতা চীনের বৈচিত্র্যময় ক্রেতাভিত্তি গড়তে ব্যর্থতার প্রমাণ।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানায়, ২০১৮-২০২২ সময়কালে চীনা অস্ত্র রপ্তানি ২৩% কমেছে, যা ইঙ্গিত করে যে চীনের এই সংকট পাকিস্তান ছাড়িয়েও বিস্তৃত।
চীনের রপ্তানি মডেল পরিমাণকে প্রাধান্য দেয় গুণমানের চেয়ে। দেশটির পশ্চিমা দেশের চেয়ে কম দামে অস্ত্র বিক্রি করে এবং সহজ শর্তে ঋণ দেয়। তবে এই কৌশল উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান যখন দাবি করে যে তাদের জে-১০সি যুদ্ধবিমান ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে, তখন চীনের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশনের (এভিআইসি) শেয়ারের দাম ৫৫ বিলিয়ন ইউয়ান বেড়ে যায়। কিন্তু স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ভারতীয় আক্রমণ ঠেকাতে পাকিস্তানের চীনা সরবরাহকৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তবতা ও বাজারের প্রচারণার এই বৈপরীত্য চীনের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটকে তুলে ধরে। এই অস্ত্র ব্যর্থতার মূল কারণ হলো চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ও প্রতিরক্ষা খাতে বিদ্যমান দুর্নীতি। চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু ও ওয়েই ফেংহেকে বহিষ্কার এবং এভিআইসি চেয়ারম্যান তান রুইসং-এর বিরুদ্ধে তদন্তের ঘটনা এ দুর্নীতি কত বড় তা স্পষ্ট করে। এই দুর্নীতির ফল হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ পণ্য, যা বাস্তব যুদ্ধে ব্যর্থ হয়।
চায়না শিপবিল্ডিং ট্রেডিং কোম্পানির পাকিস্তানে যে এফ-২২ পি ফ্রিগেট সরবরাহ করে। যেগুলোর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কাজ করত না, রাডার ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং ইঞ্জিন ছিল অপারেশনাল গতি বজায় রাখতে অক্ষম। এফএম-৯০ ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার ইনফ্রারেড সেন্সর এতটাই অকার্যকর ছিল যে পাকিস্তান সেগুলো পুরোপুরি বাদ দেয়।
২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত ছিল আধুনিক চীনা অস্ত্রের পশ্চিমা ব্যবস্থার বিপরীতে প্রথম বড় ধরনের যুদ্ধপরীক্ষা, এবং এর ফলাফল ছিল বেইজিংয়ের জন্য মারাত্মক লজ্জাজনক। এইচকিউ-৯ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা আমেরিকান প্যাট্রিয়ট বা রাশিয়ান এস-৪০০-এর সমতুল্য বলে বাজারজাত করা হয়। পাকিস্তান নয়টি স্থানে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে ইসলামাবাদের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নূর খান বিমানঘাঁটিতে সফল ভারতীয় হামলা চীনের জন্য চরম বিব্রতকর ছিল।
চীনের আক্রমণাত্মক অস্ত্র ব্যবস্থাগুলোও সমানভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুতে সিএম-৪০১ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করলেও কোনো নিশ্চিত আঘাতের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চীনের তৈরি পিএল-১৫ বিমান থেকে বিমান ক্ষেপণাস্ত্র, যা মার্কিন এআইএম-১২০ এএমআরএএএম-এর চেয়ে উন্নত বলে প্রচারিত হয়েছিল, সেটিও প্রতিশ্রুত দূরপাল্লার শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়। চীন ভারতীয় রাফাল ভূপাতিত করার অপ্রমাণিত দাবি নিয়ে উৎসব করলেও বাস্তবতা ছিল, চীনা অস্ত্র ভারতের সামরিক লক্ষ্য অর্জন থামাতে পারেনি।
পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা চীনের প্রতিরক্ষা রপ্তানির বৈশ্বিক ব্যর্থতার একটি অংশ মাত্র। ২০২২ সালে মিয়ানমার তাদের সম্পূর্ণ জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান বহর ব্যবহার বাতিল করে করে কাঠামোগত ফাটল ও রাডারজনিত ত্রুটির কারণে। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বেইজিংয়ের কাছে অভিযোগ করে যে, তিন বাহিনীর জন্য সরবরাহকৃত যন্ত্রাংশ ত্রুটিপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে কে-৮ প্রশিক্ষণ বিমান, এফ-৭ যুদ্ধবিমান এবং এমবিটি-২০০০ ট্যাঙ্ক নিয়ে। নাইজেরিয়া ৯টি এফ-৭ বিমান থেকে ৭টি মেরামতের জন্য চীনে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়, কারণ স্থানীয়ভাবে তা করা সম্ভব ছিল না। জর্ডান চীনা সিএইচ-৪বি ড্রোন ক্রয়ের এক বছরের মধ্যেই তা বিক্রি করে দেয়, যা চীনা সরঞ্জামের মানের একটি উদাহরণ। আলজেরিয়ায় ড্রোন পরীক্ষার সময় একাধিকবার দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। একাধিক দেশ ও অস্ত্রব্যবস্থার এই ব্যর্থতাগুলো দেখায়, চীনের গুণগত মানের সমস্যাগুলো পণ্য বা ক্রেতা-নির্ভর নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত।
চীনের খারাপ ডকুমেন্টেশন এই সমস্যাগুলো আরও বাড়িয়ে তোলে। কারিগরি ম্যানুয়াল আসে চীনা ভাষায় অথবা ভুল অনুবাদসহ, যা এগুলোকে ব্যবহার অনুপযোগী করে তোলে। নকশা পরিবর্তন হয় আগাম নোটিশ ছাড়াই, ফলে খুচরা যন্ত্রাংশ অমিল হয়ে পড়ে। যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাও সীমিত থাকে শুধু প্রাথমিক ব্যবহারিক স্তরে—রক্ষণাবেক্ষণ বা সমস্যা সমাধানে নয়। এই পদ্ধতিগত অবহেলা প্রমাণ করে যে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব নয়, বরং তাৎক্ষণিক বিক্রির ওপর জোর দেয়। এই বিশ্বাসযোগ্যতা সংকট চীনের নিজস্ব সামরিক ক্ষমতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। যদি রপ্তানিযোগ্য চীনা অস্ত্র এত ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়, তবে পিপলস লিবারেশন আর্মির নিজস্ব অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠায়।
চীনের পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী রকেট ফোর্সে চলমান দুর্নীতির কেলেঙ্কারিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, এই গুণগত মানের সমস্যা চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যবস্থাতেও বিদ্যমান। তাইওয়ান ও অন্যান্য সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ চীনের কথিত ও বাস্তব সামরিক সক্ষমতার ব্যবধান বিশ্লেষণ করছে।
এই কাঠামোগত ব্যর্থতা সমাধানে প্রয়োজন গোঁড়া থেকে সংস্কার, যা চীন করতে অনিচ্ছুক। প্রতিরক্ষা খাত থেকে দুর্নীতি দূর করতে গেলে কমিউনিস্ট পার্টি ও পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থে আঘাত লাগবে। গুণগত মান উন্নয়ন করলে খরচ বেড়ে যাবে, ফলে দামি গ্রাহকদের কাছে যে সস্তার সুবিধা চীন দেয়, তা হারিয়ে যাবে। ব্যাপক গ্রাহক সহায়তা দিতে হলে চীনা কোম্পানিকে বৈশ্বিক পরিষেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে, যা বর্তমানে তাদের নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫ সালের মে মাসে পাকিস্তানে যুদ্ধক্ষেত্রে চীনা অস্ত্রের ব্যর্থতা এমন ক্রেতাদেরও বিরত রাখবে, যারা পশ্চিমা অস্ত্রের বিকল্প হিসেবে চীনা সরঞ্জাম বিবেচনা করছিল।
চীনের প্রতিরক্ষা রপ্তানির ব্যর্থতা অন্য সরবরাহকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। রাশিয়া, নিজস্ব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, তুলনামূলকভাবে ভালো গুণগত মান ও যুদ্ধ-পরীক্ষিত অস্ত্র সরবরাহ করে। তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ছোট রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে নির্ভরযোগ্য বিকল্প প্রদান করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন গুণগত মানের জন্য উচ্চ মূল্য যৌক্তিক তা পশ্চিমা সরবরাহকারীরা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ব্যাখ্যা করতে পারে। বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা বাজার এখন দুই ভাগে বিভক্ত হতে পারে—যারা নির্ভরযোগ্য অস্ত্র কিনতে সক্ষম এবং যারা চীনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণ করতে বাধ্য।
যেসব দেশ বর্তমানে চীনা সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছে বা তা বিবেচনা করছে, তাদের জন্য পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। চীনা অস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও কার্যকারিতার সীমাবদ্ধতায় যে গোপন ব্যয় রয়েছে, তা প্রাথমিক সাশ্রয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—চীনা অস্ত্র সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়েই ব্যর্থ হয়।
চীনের অস্ত্র বাজারে পশ্চিমা আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন একটি গভীর বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়েছে, যা প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যর্থতার সঙ্গে আরও তীব্র হচ্ছে। পাকিস্তানের মতো সমস্যাযুক্ত গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং একাধিক দেশ ও অস্ত্র ব্যবস্থায় তাদের গুণগত মানের সমস্যাগুলো ইঙ্গিত করে যে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, যতদিন না চীন তাদের সামরিক-শিল্প কাঠামোর দুর্নীতি ও গুণগত মানের ত্রুটি দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, ততদিন তাদের তৈরি অস্ত্র তাদের মিত্রদের ব্যর্থ করে যাবে, এবং এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রাহকের নিরাপত্তা ও চীনের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা—উভয়ই।
মন্তব্য করুন