নিজস্ব প্রতিবেদক
রংপুরে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে একদল ব্যক্তি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক লিয়াকত আলী (বাদল)-কে তুলে নিয়ে হেনস্তা ও মারধর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোববার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরের কাচারিবাজার এলাকা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় সাংবাদিক সমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক লিয়াকত আলী একুশে টেলিভিশনের রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি এবং দৈনিক সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত। তিনি অভিযোগ করেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘রংপুরে জুলাই যোদ্ধাদের নামে অটোরিকশার লাইসেন্স, ৫ কোটি টাকা বাণিজ্যের পাঁয়তারা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জেরে তাঁর উপর এই হামলা চালানো হয়।
নগরের জাহাজ কোম্পানি এলাকার বাসিন্দা এনায়েত আলী (রকি) নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি দল তাঁকে কাচারিবাজার মোড় থেকে তুলে নিয়ে সিটি করপোরেশনে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং মারধর করা হয়।
লিয়াকত আলী আরও অভিযোগ করেন, এই ঘটনায় রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক শহিদুল ইসলাম এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতিমা ইন্ধন দিয়েছেন। ঘটনার প্রতিবাদে রংপুরে কর্মরত সাংবাদিকরা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। তারা জড়িত ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অপসারণের দাবি জানান।
জুলাই যোদ্ধাদের নামে চাঁদাবাজি ও হেনস্তার অভিযোগ
জুলাই যোদ্ধাদের নামে এ ধরনের অপকর্মের ঘটনা নতুন নয়। এর আগে রাজধানীর গুলশান-২ নম্বর এলাকায় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদা দাবি করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। সম্প্রতি উত্তরায় সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে আরও তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাদের কাছ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদকে ‘ডাকাত দলের সর্দার’ বলে মন্তব্য করেছেন আমজনতা দলের যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রহমান। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন প্রশ্ন তুলেছেন, বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব হান্নান মাসউদকে দেওয়ার পেছনে তার যোগ্যতা কী?
গণমাধ্যমের উপর দমন-পীড়ন
অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই গণমাধ্যমের উপর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারের শুরুতেই ১৬৭ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়, যা তাদের সরকারি কর্মকাণ্ড কাভার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এই পদক্ষেপকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে। এছাড়া, একাত্তর, সময়, এবং ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। টকশোতে কথা বলার কারণে সাংবাদিক পান্নাকে কারাগারে যেতে হয়েছে।
শরীয়তপুরে হাসপাতালের গাফিলতি নিয়ে রিপোর্ট করার পর এক সাংবাদিককে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়। অন্যদের বাঁশ-লাঠি ও গুলির মুখে পড়তে হয়েছে। সম্পাদক নাসিমা খান মন্টি, তাঁর স্বামী ও দুই মেয়ের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যাংক তদন্ত চাপানো হয়েছে। সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক ও সুমি খানও তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কারণে হামলা ও মামলার শিকার হচ্ছেন।
সাংবাদিকদের উপর নজিরবিহীন হয়রানি
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, এবং তিনজন দায়িত্ব পালনের সময় প্রাণ হারিয়েছেন। সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের বেআইনি গ্রেপ্তার, গুম, এবং ভয়ভীতি নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছেছে।
ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংবাদিকদের গায়েবি মামলায় জড়ানো হচ্ছে, যেগুলোর অধিকাংশই অতীতের রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব মামলায় দুর্বল বা পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যা স্বাধীন চিন্তাকে অপরাধে পরিণত করার সংগঠিত প্রচেষ্টার প্রমাণ বহন করে।
গণতন্ত্রের উপর হুমকি
বিশ্লেষকদের মতে, যখন ভাষাই বেআইনি হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র অন্ধকারে মারা যায়। বাংলাদেশে শব্দের উপর দমন অভিযান চলছে, যা দেশের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কেবল সেন্সরশিপ নয়, বরং ভিন্নমতকে পদ্ধতিগতভাবে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা।
শত শত সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল, গণমাধ্যম অফিসে হামলা, এবং সম্পাদক ও সংবাদপ্রধানদের অপসারণের মাধ্যমে সাংবাদিক সমাজকে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তথ্য অধিকার আইনের সংস্কারে সরকারের উদাসীনতা জনগণের জানার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে।
বাংলাদেশ এমন এক দেশে পরিণত হওয়ার পথে, যেখানে নীরবতা আরোপিত। সত্য বলা এখন সাহসী কিন্তু বিপজ্জনক কাজ। সাংবাদিকরা তাদের কণ্ঠস্বর দিয়ে এর মূল্য দিচ্ছেন।
মন্তব্য করুন