নিজস্ব প্রতিবেদক
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭ জন, আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতদের পরিবার জানিয়েছে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
বুধবার এনসিপির সমাবেশ শেষে গাড়িবহর ফেরার পথে স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়ে। এক পর্যায়ে পৌরপার্ক এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান নিরীহ পথচারীরাও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বৃহস্পতিবার থেকে শহরজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়, এখনও চলছে ১৪৪ ধারা।
নিরাপত্তা বাহিনী তল্লাশি অভিযানে নামে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আটক করে শত শত মানুষকে। পুলিশ জানায়, এ পর্যন্ত ২৭৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯ শিশু রয়েছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় গ্রেফতারদের পিরোজপুর, বাগেরহাট ও যশোরে পাঠানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, এক ব্যক্তিকে শিশুর জন্য দুধ কিনতে যাওয়ার সময়ও গ্রেফতার করা হয়।
এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর আটকে জনতার প্রতিক্রিয়ায় উত্তপ্ত হয় শহর। নিরাপত্তার স্বার্থে জেলা পুলিশ কার্যালয়ে আশ্রয় নেয় এনসিপির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম। পরে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান (এপিসি) ব্যবহার করে তারা শহর ত্যাগ করেন।
মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ-আর্মি যদি নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব।বর্তমান পরিস্থিতিকে অনেকে সেই ঘোষিত ‘যুদ্ধের’ই ফল বলছেন।
ঘটনার দিনে তোলা একটি ৩২ মিনিটের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, গোপালগঞ্জ থেকে পালানোর সময় এনসিপির গাড়িবহরের একটি গাড়ি থেকে ভিডিও ধারণ করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, গাড়িটি ব্যারিকেডে আটকে গেলে জনতা ইটপাটকেল ছুড়ে। একটি ইট গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়। পরবর্তীতে গাড়ির আরোহীরা সেনাবাহিনীকে গুলি চালাতে চাপ দেয়। এক পর্যায়ে রাকিব নামে একজন বলেন, “এবার তাদের ফুল এক্সেস দেয়া হয়েছে গুলি করার, কিন্তু একটা গুলিও তারা করে নাই।”
এই বক্তব্য থেকেই ধারণা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীকে গুলি চালানোর ‘ছাড়পত্র’ দেয়া হয়েছিল। ভিডিওতে আরও শোনা যায়, গাড়ির আরোহীরা গুলির শব্দে উল্লাস করছে এবং পরে গোপালগঞ্জবাসীর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে।
একপর্যায়ে একজনকে ফোনে বলতে শোনা যায়- আমি ঢাকা শহরে গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগের কোনো লেস্পেন্সার রাখবো না। যেখানেই পাই, জবাই করবো। তুই রেডি রাখ, AK-47 সহ ৮০টা অস্ত্র রেডি রাখবি। চিরুনি অভিযান করবো ঢাকা শহর থেকে।”
এছাড়া ভিডিওতে সেনাবাহিনীর সংখ্যা ও সক্ষমতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়, কেন মাত্র একটি এপিসি দেয়া হলো, কেন হেলিকপ্টার দিয়ে হামলা চালানো হয়নি — তা নিয়েও হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা।
গাড়ির এক আরোহী বলেন, পলিটিক্স করতে নামলে ফার্স্ট এইড কিট সাথে রাখতে হয়। পরে থাকবে আর্মস আর বুলেটও। ৩১ মিনিটের দিকে রাকিবকে ঢাকায় তানভীর নামে একজনকে ফোনে বলতে শোনা যায়- পুরা ঢাকা শহর অচল করে দিবা। আওয়ামী লীগের যতগুলা আছে সব খুইজা মাইরা ফেল। এনসিপি ও ছাত্রদলসহ অন্যদের সঙ্গে সমন্বয়ের কথাও উঠে আসে কথোপকথনে।
প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্ন
এ ঘটনায় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও বিশ্লেষকরা। অনেকেই গোপালগঞ্জের পরিস্থিতিকে গাজা বা কাশ্মীরের সঙ্গে তুলনা করছেন। গুলিবর্ষণ, গণগ্রেফতার, নিখোঁজ, কারফিউ, এবং সেনা অভিযানে এই জেলা কার্যত বিচ্ছিন্ন এক অস্থিরতায় পরিণত হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে — গোপালগঞ্জ কি সত্যিই যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে?
মন্তব্য করুন