নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ আগস্ট একটি ভয়াল ও নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের দিন হিসেবে পরিচিত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জঙ্গিগোষ্ঠী নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালায়। এই হামলায় নিহত হন ২৬ জন নেতাকর্মী, গুরুতর আহত হন প্রায় ৩০০ জন, যাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উইকিলিকসের প্রকাশিত গোপন নথি অনুযায়ী, এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনায় সম্মতি ছিল বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। হামলার আগে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী ‘একশন এবং বিস্ফোরণে যাওয়ার জন্য এগিয়ে যাওয়ার’ নির্দেশ পান।
২০০৪ সালে তারেক রহমান তাদের বলেন, একশন এবং বিস্ফোরণে যাওয়ার জন্য এগিয়ে যান। লুৎফুজ্জামান বাবর, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, হ্যারিস চৌধুরী, এরপর প্রধানমন্ত্রীর সচিব, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াত-ই-ইসলামি মহাসচিব, তারপর এনএসআই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. আবদুর রহিম এবং ডিজিএফআই পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজাকুল হায়দার চৌধুরী ছিলেন। যে বৈঠকে রাজধানীর বনানী হাওয়া ভবনে অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া কাশ্মিরভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, হিজবুল মুজাহিদিন, তেহরিক জিহাদ-ই ইসলাম, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং মিয়ানমারভিত্তিক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) বেশ কয়েকটি বিদেশি গোষ্ঠী এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে দুটি জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান হয়। একটি হচ্ছে কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক হরকাতুল জিহাদ (হুজি), যার নেতৃত্বে ছিল আফগানফেরত কয়েক যোদ্ধা। অপরটি মধ্যপ্রাচ্যপন্থি জেএমবি। উভয় দলের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকলেও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কারণে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে জামায়াত। শিবিরের সাবেক ক্যাডাররা যুক্ত হয়েছিল এসব দলে।
চার্জশিট, বাদীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি হান্নান এবং খালেদা জিয়ার ভাগনে ও তৎকালীন এপিএস-১ সাইফুল ইসলাম ডিউকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এটি পরিষ্কার যে এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এই কাজের জন্য হুজি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। অবশ্য, হুজিদের বিকৃত মতাদর্শের কারণে তাদের খুব বেশি অনুরোধ করতে হয়নি। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের জন্য শেখ হাসিনাকে তারা ‘ইসলামের শত্রু’ বলে বিবেচিত করতো। হামলার কয়েকদিন আগেই গুলশানে ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিত তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিলো।
অবশ্য ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে সিঙ্গাপুরে দাউদ ইব্রাহিম এবং আইএসআইয়ের সঙ্গে তারেক রহমানের অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয় বলে বিভিন্ন কলাম লেখকের উপস্থাপিত তথ্য থেকে জানা যায়। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীকে সহায়তা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে মূল বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ২১ আগস্ট হামলার পরিকল্পনা করা হয়।
জিয়া পরিবারের পাচারকৃত অর্থ বিনিয়োগের জন্য বিদেশে তৈরি দুটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অর্থ লেনদেন হয়। আর ‘আর্জেস’ গ্রেনেডও সংগৃহীত হয় এই অর্থের মাধ্যমে। আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড অস্ট্রিয়ায় এবং অস্ট্রিয়ার লাইসেন্সের ভিত্তিতে পাকিস্তানে তৈরি হয়। এ উপমহাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছাড়া কেউ এ গ্রেনেড ব্যবহার করে না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত গ্রেনেড হচ্ছে আর্জেস-৭২। ওই আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড ভারতে লস্করে তৈয়বা কর্তৃক ১৯৯৩ সালে মুম্বাই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল। একই গ্রেনেড ব্যবহার করা হয় সিলেট হামলায় ও শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে।
আগস্ট মাসেই তারেক রহমান এবং তার অন্য সহযোগীদের সঙ্গে হুজি সন্ত্রাসীরা ‘হাওয়া ভবনে’ সাক্ষাৎ করে নির্দেশনা নেয় এবং সার্বিক প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করে। এই সহযোগীদের মধ্যে রয়েছে- তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিব ও তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআই এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম ও ডিজিএফআই’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজর নূর চৌধুরীও সেই হামলার ঘটনায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিল। বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি মেজর ডালিম সেসময় ঢাকায় এসেছিল বলে জানা গেছে।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনে বিএনপি’র সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ হুজি আক্রমণকারীদের এবং বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করে। হাওয়া ভবন ছাড়াও মোহাম্মদপুরের হুজি’র আস্তানায় এবং ধানমন্ডিতে বিএনপি’র উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে অন্যান্য পরিকল্পনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সময় তাজউদ্দীন নামের একজন হুজি সদস্য হত্যাকারীদের কাছে গ্রেনেড সরবরাহ করে। এই হামলায় আরও একজন অভিযুক্ত আসামি পাকিস্তানি সন্ত্রাসী আবু ইউসুফ এক স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-জিহাদির (টিজেআই) নেতা মুজফফর শাহ গ্রেনেডগুলো তাজউদ্দিকে সরবরাহ করে। কীভাবে হুজিরা বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর থেকে সমর্থন নিশ্চিত করেছিল সে বিষয়েও এই ব্যক্তি কথা বলে।
গ্রেনেডের উৎস সম্পর্কে আরও জানা যায়, খালেদা জিয়া সরকারের নির্দেশ মোতাবেক পাকিস্তান থেকে কলকাতার জঙ্গি গ্রুপ আসিফ রেজা কমান্ডো কোম্পানির জন্য আনা ৮ প্যাকেট আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড থেকে দুটি প্যাকেট রেখে দেওয়া হয় বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য। প্রতি প্যাকেটে গ্রেনেড থাকে ২৪টি। তৎকালে উলফা ও আসিফ রেজা কোম্পানির মাধ্যমে ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন, লস্করে তৈয়বাসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কাছে পাকিস্তান থেকে আনা অস্ত্র সরবরাহ করা হতো।
হামলার একদিন আগে ২০ আগস্ট হুজি হত্যাকারীরা, কাজল এবং আবু জান্দাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার স্থান পরিদর্শন করে। অপারেশনটির নাম ছিল ‘লাইট স্ন্যাক্স ফর শেখ হাসিনা’ (শেখ হাসিনাকে নাশতা করানো)। ২১ আগস্ট তারা বাড্ডায় একটি পূর্বনির্ধারিত বাড়িতে সাক্ষাৎ করে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে হামলাকারী কাজল ও আবু জান্দালের নেতৃত্বাধীন মোট ১২ জন ওই ঘটনায় অংশ নেবে।তারপর তারা একসঙ্গে নামাজ পড়বে এবং মধ্যাহ্নভোজ করবে।
চূড়ান্ত বৈঠকের পর মাওলানা সাঈদ ‘জিহাদ’ সম্পর্কে বক্তৃতা দেয়। এরপর মুফতি হান্নান ১২ জন হামলাকারীর কাছে ১৫টি গ্রেনেড হস্তান্তর করে। আলোচনা অনুযায়ী আসরের নামাজের পর তারা সবাই গোলাপ শাহ মাজারের কাছে উপস্থিত হয়। এরপর তারা ট্রাকের চারপাশে অবস্থান নেয় যেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন। শেখ হাসিনার বক্তব্য শুরু হলে আবু জান্দাল প্রথম গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করে। তারপর, প্রত্যেকে নিজের গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ওই স্থান ত্যাগ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “যদি বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্ব আবার ক্ষমতায় আসে, তবে অতীতের ইতিহাস ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রশ্ন পুনরায় গুরুত্ব পাবে। ২১ আগস্টের মতো নৃশংস ঘটনার প্রভাব এখনও রাজনীতিতে রয়ে গেছে। তবে বর্তমান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো, তারা জনগণের আস্থা ও সমর্থন ফিরে পাবে কি না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক একটি সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন করা।
মন্তব্য করুন