নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে তিন বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের একটি মিশন স্থাপনের প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের ৩৩তম বৈঠকে। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এ অনুমোদনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিভিন্ন গোষ্ঠী আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, এটি দেশের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে মার্কিন স্বার্থ বাস্তবায়নের একটি ধাপ। অনেকেই বলছেন, এটি “আমেরিকার হাতে দেশ তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের” অংশ, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ইউনূস গং।
রোহিঙ্গা ইস্যু ও ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৮ সালে মিয়ানমারে চীন-সমর্থিত গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র সেখানে অস্থিতিশীলতা তৈরির কৌশল নেয়। রোহিঙ্গা সংকট, মানবিক করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
‘বাংলাদেশের অং সান সুচি’ ড. ইউনূস?
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, ড. ইউনূস এখন বাংলাদেশের 'অং সান সুচি'—যাকে মার্কিনিরা ক্ষমতায় বসিয়েছে কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায়। বিশ্লেষকদের মতে, তার ভবিষ্যৎও সুচির মতো হতে পারে—যদি তিনি পশ্চিমা স্বার্থ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন।
একাধিক সূত্র দাবি করছে, ড. ইউনূসকে জাতিসংঘ মহাসচিব করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে একটি "প্রক্সি যুদ্ধের" মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বাইডেন প্রশাসন। যার মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সহায়তা এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশে পূর্ব তিমুরের মতো একটি খ্রিস্টান রাজ্য বানাতে চায় আমেরিকা।
পূর্ব তিমুরেও জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস ছিল, যা দেশটির বিভাজনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। এখন অনেকে আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশে সেই একই কৌশল প্রয়োগ হতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে "পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিষ্টান দেশ" গঠনের ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে এয়ার বেজ স্থাপনের প্রস্তাবও এসেছে, যদিও কোন দেশ এই প্রস্তাব দিয়েছে তা প্রকাশ করেননি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের দখল, রোহিঙ্গা করিডোর এবং কৌশলগত বন্দর ব্যবহার ঘিরে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম ক্ষেত্র। এই অবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এর আগে ২০২৪ সালের ২৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিষ্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বাংলাদেশে এয়ার বেজ বানানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে কোন দেশ এই প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি উল্লেখ করেননি প্রধানমন্ত্রী।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে হেফাজতে ইসলাম ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। হেফাজতের আমির শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, "বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেয়া হবে না। ইসলামী মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠিত এই দেশে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।"
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা 'মানবাধিকার'-এর নামে ইসলামি শরিয়াহ ও পারিবারিক আইনে হস্তক্ষেপ করেছে—এটা আবারও ঘটতে পারে। তবে এ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কারণ এই দলটি আমেরিকার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত।
অন্যদিকে, সিপিবি মহাসচিব রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটে নেই। তাই জাতিসংঘের এই অফিস অপ্রয়োজনীয়। অতীতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা তেমন দেখা যায়নি। এতে মানুষের মধ্যে সন্দেহ জন্মেছে যে তারা কোনো গোপন উদ্দেশ্যে আসছে কিনা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন না হলে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।
মন্তব্য করুন