নিজস্ব প্রতিবেদক
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে শুরু হয়েছে পদোন্নতির নামে নজিরবিহীন কোরামপ্রীতি ও দুর্নীতির মহোৎসব। সরকারি সার্ভিস রুলস উপেক্ষা করে সম্প্রতি প্রায় ১,৪০০ চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়া হলেও নিয়ম মেনে যোগ্য ৮৭৯ চিকিৎসককে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪৯০ জন নারী চিকিৎসক—যাদের বঞ্চনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে চলে আসা সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) ও বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির স্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে একটি ৬ সদস্যের তথাকথিত ‘চিকিৎসক প্রতিনিধি কমিটি’ প্রমোশন তালিকা পর্যালোচনা করছে, যেখানে বিএনপি ও জামায়াতঘনিষ্ঠ সদস্যরাই প্রভাব বিস্তার করছে। এই কমিটি আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের চিহ্নিত করে বাদ দিচ্ছে, আর রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে প্রমোশন দিচ্ছে ‘নিজেদের লোকদের’।
পদোন্নতির এ অনিয়মের চিত্র বিভিন্ন সরকারি প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট। ১৭ জুলাই, ২৯ জুলাই, ১ সেপ্টেম্বর, ২ সেপ্টেম্বর এবং ২৩ অক্টোবর ২০২৫—এই পাঁচ দফায় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে ৮৭৯ জন চিকিৎসককে নিয়মবহির্ভূতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত ২৩ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপনে ২৮৫ জন নারী চিকিৎসককে একসঙ্গে বাদ দেওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রশাসনে। অনেক বঞ্চিত চিকিৎসক রিটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গোপনীয়তার শর্তে জানান, “আমরা নিয়ম অনুযায়ী তালিকা প্রস্তুত করেছিলাম, কিন্তু স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নির্দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সচিব আপত্তি করলেও প্রধান উপদেষ্টার ফোনে তাঁকে বাধ্য করা হয় সই করতে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ‘সংস্কার সরকারের’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন দুর্নীতির অন্যতম বড় ঘাঁটিতে পরিণত হচ্ছে। যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রমোশনের মূল মাপকাঠি বানানোয় মেধাবী চিকিৎসকদের মনোবল ভেঙে পড়ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কনভেনর ডা. আহমেদ মুস্তাক রাজা চৌধুরী বলেন, “স্বাস্থ্য খাতের ইতিহাসে এমন কোরামপ্রীতি আমরা দেখিনি। সংস্কারের নামে এখন চলছে লুণ্ঠন। আগে অন্তত যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশন হতো, এখন সেটা রাজনৈতিক দরকষাকষিতে নির্ধারিত হচ্ছে।”
বঞ্চিত নারী চিকিৎসকরা বলছেন, তারা নিয়ম মেনে ১৫ বছর ধরে চাকরি করেছেন, কিন্তু এখন রাজনীতির বলি হয়েছেন। এক চিকিৎসকের ভাষায়, “আমরা রোগীদের সেবা দেই, রাজনীতি করি না। কিন্তু এখন পদোন্নতি মানে রাজনৈতিক লয়ালটি টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়া।”
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এমন কোরামপ্রীতি এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ স্বাস্থ্য খাতের সুশাসন ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে গভীর সংকট তৈরি করেছে।
এখন প্রশ্ন একটাই — স্বাস্থ্য সংস্কারের নামে কি নতুন এক দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে উঠছে?
মন্তব্য করুন