নিজস্ব প্রতিবেদক
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সারা দেশে বইছে ভুয়া মামলার এক ভয়াবহ সুনামি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে এসব মামলা ও সহিংসতার ঘটনায় বাড়ছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। আলোচিত ব্যক্তি, সাবেক মন্ত্রী, বিচারপতি এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হচ্ছে হাস্যকর ও অবিশ্বাস্য অভিযোগ। এর সঙ্গে মব সন্ত্রাস, নাটকীয় গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক হিংসার জড়াজড়ি পরিস্থিতিকে করে তুলছে আরও ঘোলাটে।
সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে ভালো অভিজ্ঞতা অল্প, খারাপ অভিজ্ঞতাই বেশি। তিনি অভিযোগ করেন, ফেসবুক দেখে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সেইসঙ্গে ভুয়া মামলার সমালোচনাও করেন তিনি।
আলোচিত ব্যক্তি ধরতে নাটক মঞ্চায়ন
এই সরকার প্রথম গ্রেপ্তার দেখায় সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গল্প অনুযায়ী, তারা নাকি চুল-দাড়ি কামিয়ে, লুঙ্গি পরে নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন—গোটা জাতিকে এক ব্যঙ্গাত্মক দৃশ্যের সাক্ষী বানানো হয়। এমন হাস্যকর নাটকেও সরকারের লজ্জা হয়নি। তারপর তাদের জড়ানো হয় নিউমার্কেটের একটি খুনের মামলায়, যেন তারা পেশাদার খুনি!
সম্প্রতি একই প্রহসনের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ক্ষেত্রে। যিনি কলমের খোঁচায় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা—তত্ত্বাবধায়ক সরকার—বাতিল করে রাজনৈতিক সংকটের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন, আজ তাকেই যাত্রাবাড়ীতে যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়ার কোনো সুস্থ মানুষ কি এটা বিশ্বাস করবে? কিন্তু ড. ইউনূসের সরকার আদালতকে ব্যবহার করে জনগণকে এসব বিশ্বাস করাতে চায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আদালতকে প্রহসনের মঞ্চ বানিয়ে সত্যিকারের অপরাধ আড়াল করে—ড. ইউনূসের সরকার ভুয়া মামলার নাটক রচনা ও মঞ্চায়নে চ্যাম্পিয়নের চেয়ে কিছু কম নয়।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বিতর্কিত ভূমিকা
সাবেক বিএনপি নেতা এবং বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে বলেন, “মব সন্ত্রাস বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থা নয়, বরং ১৭ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ। তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এই বক্তব্য রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে বৈধতা দিচ্ছে। একইসঙ্গে টাকা না দিলে আদালত প্রাঙ্গণে মব লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
টাকা না দিলে আদালত পাড়ায় হয় মব
বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক থাকার সময় আসাদুজ্জামান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমর্থন নিয়েছেন। তারা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ আওয়ামী লীগের নামে বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর মানবাধিকার লঙ্ঘন চলে গেছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। সূত্র বলছে, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রণালয়ে ৬ থেকে ৮ কোটি টাকার লেনদেন না দিতে পারলে মব লেলিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে তাদের ভুয়া মামলা বাণিজ্য তো আছেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের অফিস বরাবরই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে, কিন্তু বাস্তবতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিচার করেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা, যিনি দায়িত্বে আছেন কিন্তু পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকার শর্তে বলেন, মব লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও গড়ে উঠেছে এই অবৈধ লেনদেনের কারণে। যারা আইনি প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে চায়, তারা এই ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবহার করছে। ভুয়া মামলা দায়ের, অপ্রয়োজনে মামলা টানাটানি এবং নির্যাতন অনেক সময় এই আর্থিক লেনদেনের সাথে জড়িত।”
গত ১৩ মে ঢাকা আদালত প্রাঙ্গণে বিচারক মমতাজ বেগমকে ধাওয়া করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আদালত প্রাঙ্গণেই সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক-এর ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা হয়।
এছাড়া সম্প্রতি ঢাকার শেরেবাংলা নগরে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা-র বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে পুলিশকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেলেও হস্তক্ষেপ করেনি তারা। পরে হুদাকেই গ্রেফতার দেখানো হয়।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলার শিকার হয়েছেন অনেক সাধারণ নাগরিক, এমনকি সরকারের প্রাক্তন কর্মকর্তারাও। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বাড়ি ধ্বংস ও গাজীপুরে সাবেক এক মন্ত্রীর বাসায় হামলার ঘটনা এসব সহিংসতার গভীরতা ও বিস্তারের প্রমাণ দেয়।
গবেষণা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হন।
বিশ্লেষকদের মতে, আইনকে পাশ কাটিয়ে বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। তারা বলছেন, এই ধরনের সহিংসতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নয়, বরং সাধারণ নাগরিককেও আতঙ্কিত করছে।”
ভুয়া মামলার উদ্বেগজনক চিত্র
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশে মিথ্যা মামলা দায়েরের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলার অপব্যবহার হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব মামলার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান না নিয়ে বরং নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ-এর ফুলবাড়ীয়া এলাকার সোলায়মান সেলিম নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, তাকে “মৃত দেখিয়ে” একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ তার ঠিকানায় তদন্তে গেলে তিনি নিজেই ‘ভুয়া মৃত্যু’ ও মামলার কথা জানতে পারেন। নিজের জীবনের নিরাপত্তার আশঙ্কায় তিনি স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
ঘটনাটি ঘটে ৩ আগস্ট, ঢাকার কাজলা এলাকায় গুলির ঘটনা দেখিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী সেলিমের বড় ভাই। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা-কে। অন্যান্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শামীম ওসমান সহ আরও ৪১ জন, এবং অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ১৫০-২০০ আওয়ামী লীগ কর্মী।
এর আগে, ১৭ অক্টোবর খিলগাঁও থানায় জহিরুল ইসলাম খান পান্না (জেড আই খান পান্না)-এর বিরুদ্ধে একটি ভুয়া হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহাদুল ইসলামকে গুলি ও মারধর করে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু মামলার বাদী মো. বাকের সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করেন যে, তিনি পান্নাকে চেনেন না এবং মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে তাও জানেন না। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে পান্না জামিন পান।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে রবি দাস নামে এক মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে। ৬৪ বছর বয়সী এই মুচি ১৮ জুলাই স্ট্রোক করে মারা যান। কিন্তু তার মৃত্যুকে ঘিরে ২৯ নভেম্বর একটি মামলা দায়ের করা হয়—যেখানে অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তাকে হত্যা করেছে। মামলায় ৪৫০ জনেরও বেশি আসামি করা হয়, যার মধ্যে ১৬৮ জনের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, এমনকি শেখ হাসিনার নামও সেই তালিকায় রয়েছে। দুলালের ছেলে বিকাশ দাস বলেন, "আমরা চাই না কেউ আমার বাবার নাম ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করুক।"
এছাড়াও, ২৭ অক্টোবর ফেনীতে দায়ের হওয়া একটি মামলায় ৮৫ জনকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে রয়েছেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। মামলায় ঢাকায় বসবাসরত ব্যবসায়ী ইব্রাহিম পাটোয়ারীকেও আসামি করা হয়, যিনি আদালত থেকে জামিন পান। ইব্রাহিম বলেন, "আমি ওই সময় ফেনীতে ছিলাম না। শেখ হাসিনার পক্ষে কোনো আন্দোলনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।"
মানবাধিকার সংগঠন ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন এবং বিরোধীদের হেয়প্রতিপন্ন করা।
আইনজীবীরা বলছেন, “জুলাই মাসের আন্দোলনের পর দায়ের হওয়া মামলাগুলো এখন দুর্নীতির উৎসে পরিণত হয়েছে। অনেক মামলায় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগেরই কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ভুয়া মামলা, বিচারবহির্ভূত সহিংসতা ও রাজনৈতিক হিংসার যে প্রবণতা গড়ে উঠেছে, তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য চরম অশনিসংকেত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং রাজনৈতিক সংহতির জন্য এখনই প্রয়োজন কার্যকর ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ।
মন্তব্য করুন