নিজস্ব প্রতিবেদক
কয়েক দিন পরপর বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নতুন শিরোনাম আসে।নতুন মামলা, আরেকটি চাঞ্চল্যকর অভিযোগ, কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নতুন ব্রিফিং। এসব ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনা, তাঁর সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, এমনকি তাঁর বোন শেখ রেহানা ও তাঁর তিন সন্তানকে টার্গেট বানানো হয়। এসব মামলা ন্যায়বিচারের জন্য নয় বরং অনেক বেশি পরিকল্পিত রাজনৈতিক নাটকের মতো সাজানো।
“মিথ্যা ও হয়রানিমূলক” অভিযোগ— টিউলিপের দাবি
প্যাটার্নটা স্পষ্ট। একদিন দুদক ঘোষণা করে হাসিনাকে ভারতে থেকে ফেরত আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। আরেকদিন আদালত দ্রুত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। আবার কখনো প্লট বণ্টন মামলায় সাক্ষ্য, তো কখনো মিডিয়ায় নতুন দুর্নীতির অভিযোগ ছড়িয়ে দেওয়া। সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে পরিবারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দুদককে চ্যালেঞ্জ করছেন প্রমাণ হাজির করার। সবকিছু যেন আইনি প্রক্রিয়ার চেয়ে বেশি সাজানো নাটক, যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক প্রভাব সর্বোচ্চ করা।
এতে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা হলো: একটি দুর্নীতি দমন সংস্থা রাজনৈতিক অস্ত্রের মতো ব্যবহার হচ্ছে। মামলার পর মামলা সাজিয়ে জনমত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। এসব মামলা আলাদা আইনি প্রক্রিয়া নয়; বরং শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার ধ্বংস ও তাঁর পরিবারকে জনগণের চোখে অকার্যকর করার বৃহত্তর এক ষড়যন্ত্রের অংশ।
গ্রেপ্তার ও প্রত্যর্পণের নাটক
অন্তর্বর্তী সরকার ও দুদক শেখ হাসিনার আইনি লড়াইকে রূপ দিয়েছে এক প্রকাশ্য নাটকে। প্রতিটি পদক্ষেপকে রূপ দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক থ্রিলারের মতো কাহিনিতে। গোপন “এক্সক্লুসিভ তথ্য” ফাঁস, সরকারি বিবৃতি, আদালতের নাটকীয় সিদ্ধান্ত— সবকিছু যেন হাসিনার ভাবমূর্তি ধ্বংস করতেই সাজানো।
নাটকের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো হাসিনাকে ভারতে থেকে প্রত্যর্পণের দাবি। গণমাধ্যমে “গ্রেপ্তারি পরোয়ানা”, “অনুপস্থিতিতে বিচার” ইত্যাদি শিরোনাম ছড়িয়ে এমন বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে যে প্রমাণ হাজির হওয়ার আগেই তিনি দোষী। অথচ বাস্তবে প্রত্যর্পণের জন্য শক্ত আইনি ভিত্তি, গুরুতর অপরাধের প্রমাণ এবং রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন, যা এখনো স্পষ্টভাবে দেখানো হয়নি।
রেড নোটিশ খেলা
আদালত ও গণমাধ্যমের নাটকের বাইরে দুদক চালু করেছে তথাকথিত “রেড নোটিশ” খেলা। পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুলের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের নোটিশ জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে তাঁরা যেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে “রাষ্ট্রের পলাতক” হিসেবে চিহ্নিত হন।
এ প্রচেষ্টা আসলে আইনি চেয়ে বেশি প্রতীকী। কারণ ইন্টারপোল নোটিশ কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নয়। এর জন্য শক্ত প্রমাণ প্রয়োজন । এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নোটিশে ভারত বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশের অভিযোগে সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে এই প্রচেষ্টা মূলত ভয় দেখানো ও রাজনৈতিক চাপে রাখার কৌশল।
আদালতের নাটক ও মিডিয়ার স্পিন
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা, জয় ও পুতুলের বিরুদ্ধে মামলাগুলো এখন ন্যায়বিচারের চেয়ে বেশি লোকদেখানো হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বাচল প্লট মামলাতেই দেখা গেছে সাক্ষীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাক্ষ্য দিচ্ছে, অথচ অভিযুক্তরা হাজার মাইল দূরে বসে আত্মপক্ষ সমর্থন বা জেরা করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে মিডিয়ায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বা আদানি বিদ্যুৎচুক্তি নিয়ে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে। অথচ বাস্তবে রাশিয়ার রোসাটম এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ দুটোই নিশ্চিত করেছে— কোনো দুর্নীতি হয়নি। তবুও এসব সত্য আড়ালে পড়ে যাচ্ছে, আর প্রচার হচ্ছে সাজানো কাহিনি।
প্রতিটি রাজনৈতিক নাটকেরই একটি উদ্দেশ্য থাকে।আর শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে ঘিরে যে প্রদর্শনী সাজানো হচ্ছে, সেটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বাইরে থেকে এগুলো আদালতের শুনানি, সাক্ষীর জবানবন্দি আর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মতো মনে হলেও, বাস্তবে এগুলো একটি সুচারুভাবে পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প। লক্ষ্য ন্যায়বিচার নয়, বরং কলঙ্ক আর অপমানের মাধ্যমে বৈধতা অর্জন। শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে জয়, মেয়ে পুতুল এবং এমনকি তাঁর পরিবারকেও সাজানো মামলায় টেনে এনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও এর পৃষ্ঠপোষকেরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সুনাম ধ্বংস করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নতুনভাবে সাজাতে চাইছে।
মূলত এই নাটক তিনটি পারস্পরিকভাবে জড়িত উদ্দেশ্য পূরণ করছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলছে। নিম্নে এই তিনটি উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হলো-
প্রথমত, শেখ হাসিনা ও তাঁর উত্তরাধিকারের সুনাম নষ্ট করার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে। দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। তাঁর নেতৃত্বে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ খাতের সংস্কারের মতো উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো এমনকি তাঁর সমালোচকেরাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু বর্তমানে আদালতের বিচার প্রক্রিয়া ও মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া তথ্যের মাধ্যমে এই অর্জনগুলোকে ‘দুর্নীতি’র একটি সরলীকৃত আখ্যান দিয়ে ম্লান করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। শেখ হাসিনাকে অবৈধ চুক্তির মূল হোতা হিসেবে উপস্থাপন করে তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ধ্বংস করা হচ্ছে, যাতে তাঁর সরকারের সাফল্যগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই কৌশলের লক্ষ্য হলো তাঁকে লোভ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতীকে পরিণত করা, যার ফলে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে গর্ব ও বৈধতার অনুভূতি ক্ষুণ্ণ হবে।
দ্বিতীয়ত, এই আক্রমণ শুধু শেখ হাসিনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্বকে দুর্বল করার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে আধুনিকায়নের অন্যতম প্রধান কারিগর হিসেবে পরিচিত, এবং তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বীকৃত। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি জটিলতা ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কলঙ্কিত করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে। এই কৌশলের মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হচ্ছে—যদি শেখ হাসিনা রাজনীতি থেকে সরে যান, তাঁর সন্তানরাও এতটাই কলঙ্কিত হবে যে তারা আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে পারবে না। এভাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বংশধারাকে মূল থেকে উৎপাটন করার একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য হলো অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে ক্ষমতায় থাকা এই সরকার একটি বর্ণনা তৈরি করছে, যেখানে পূর্ববর্তী সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নৈতিকভাবে দেউলিয়া হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই বর্ণনার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে দেশের ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। আদালতের বিচার, মিডিয়ার শিরোনাম এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফাঁস হওয়া তথ্যের মাধ্যমে তারা এই কৌশলকে শক্তিশালী করছে। তাদের লক্ষ্য হলো জনগণ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করা যে শেখ হাসিনার অপসারণ কোনো অভ্যুত্থান নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক পরিশুদ্ধির জন্য একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। এইভাবে, তারা তাদের শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জনগণের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করছে।
এই তিনটি উদ্দেশ্য একে অপরের সঙ্গে জড়িত এবং রাজনৈতিকভাবে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে এই নানা ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়; ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন অন্তর্বর্তী সরকার কেলেঙ্কারি, কলঙ্ক আর নির্বাচিত ন্যায়বিচারের রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছে। আদালত এখন আর নির্দোষ বা দোষী নির্ধারণের স্থান নয়; বরং এটি বর্ণনা তৈরির জায়গা।
শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে আইনের দৃষ্টিতে দোষী প্রমাণ করা নয়, বরং জনগণের কল্পনায় তাঁকে দোষী বানানো। যাতে ইতিহাস লেখা হলে তাঁর অধ্যায় সম্মানের সাথে নয়, অপমানের সাথেই শেষ হয়। সেই দিক থেকে এই বিচার, সাক্ষ্য আর সংবাদ শুধু কিছু ব্যক্তিকে ঘিরে নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ডিএনএ নতুন করে লেখার প্রক্রিয়া।
মন্তব্য করুন